হাজারো বাঁধায় ক্রিকেট ছাড়েনি লক্ষ্মীপুরের আঁখি
গ্রামের অন্যসব মেয়ের মতোই সমাজের রীতিনীতি মেনে চলতেন তিনি। নারী হয়ে শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলায় কাল হয়েছে তার। এজন্য চলার পথে বহুবারই শিকার হয়েছেন ইভটিজিংয়ের। পরিবার ও নিজে শুনেছেন স্থানীয়দের বিভিন্ন অপমানজনক কথা। সেগুলোর প্রতিবাদ করার সামর্থ থাকলেও করেননি কখনো। উল্টো পূর্বের চেয়ে বেশি মনোযোগি হয়েছেন ক্রিকেট খেলায়। প্রতিজ্ঞা করেছেন সফলতার মাধ্যমে এসবের জবাব দেওয়ার। লক্ষ্মীপুরের নারী ক্রিকেটার আঁখি আক্তার প্রতিনিধি এসব কথা বলেন।
আঁখি বলেন, একসময় নিজ এলাকায় ছিল তার অনেক বান্ধুবী। তাদের সাথে স্কুলে আসা যাওয়াসহ অবসর সময় কাটাতেন। শুধু ক্রিকেট খেলায় কেউ আর তার সাথে মিশতো না। বরং ব্যাটা ছেলে ব্যাটা ছেলে বলে বিভিন্ন কথা বলতো। মাঝে মাঝে বিয়ে হবে না বলে অভিশাপও দিতো। কিন্তু তাতেও ক্রিকেট ছেড়ে দেয়নি আঁখি আক্তার। বন্ধুত্ব গড়ে তুলেন ব্যাট, বল আর ২২ গজের পিচের সাথে। চালিয়ে যান নিয়মিত প্যাকটিস। অবশ্যই বর্তমানে তার একজন বান্ধুবী রয়েছে। যার নাম রিয়া আক্তার শিখা। তিনিও তার মতো একজন নারী ক্রিকেটার।
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার লাহারকান্দি গ্রামের ইসলাম রাজ বাড়ির কামাল হোসেনের মেয়ে আঁখি আক্তার। ৫ বোনের মধ্যে চতুর্থ সে। উত্তর লাহারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমাপনি ও বাইশমারা মডেল একাডেমী থেকে এস এস সি শেষ করেছেন তিনি। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যয়নরত। ছোটবেলা থেকে আখির ইচ্ছা ছিল পুলিশ হওয়ার। সে জন্য পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চতা কম হওয়ায় বাছাইয়ে বাদ পড়ে ভেঙ্গে যায় তার স্বপ্ন।
বাল্য বিবাহ রোধে বেসরকারি এনজিও প্রতিষ্ঠান ব্রাক ২০১৪ সালে মেয়েদের নিয়ে একটি ক্রিকেট টুনামেন্টের আয়োজন করে। আর সেখানে কোন অভিজ্ঞতা ছাড়া খেলার সুযোগ হয় আঁখি আক্তারের। এরপর থেকে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছা জাগে তার। পরে লক্ষ্মীপুর জেলা ক্রিকেট একাডেমীতে ভর্তি হয় সে। কিন্তু ব্যাট, বল থেকে শুরু করে ক্রিকেটের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো না থাকায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো তার প্যাকটিস। কারন সামান্য বেতনে চাকুরি করা বাবার পক্ষে সম্ভব নয় এগুলো ক্রয় করে দেওয়ার। সেই মুহুর্তে ক্রিকেট কোচ মনির হোসেন আখিকে উপহার দেন জার্সি, প্যান্ট ও জুতা। বিনামূল্যে একাডেমীতে প্যাকটিস করার সুযোগ করে দেয়। কিছুদিন পর প্রতিভাবান এই নারী ক্রিকেটারকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নিয়ে যায় বিকেএসপিতে। সেখানে জাতীয় দলের কোচদের অধিনে এক মাস প্যাকটিস করেছেন।
লক্ষ্মীপুরের এই নারী ফাস্ট বোলার ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিভাগ মহিলা ক্রিকেট লীগে অংশগ্রহণ করেন আজাদ স্পোটিং ক্লাবের হয়ে। সেখানে সে ৬ ম্যাচে ১৬ উইকেট পায়। এরপর ২০১৭ সালে বেগম আনোয়ারা স্পোটিং ক্লাব ও ইন্দিরা ক্লাবের হয়ে ২০১৮ সালে ওই টুনামেন্টে অংশগ্রহন করেছেন। সর্বশেষ অনূর্ধ্ব-১৮ জাতীয় ক্রিকেট লীগে চট্টগ্রামের বিভাগীয় দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই টুনামেন্টে ৬ ম্যাচে ২১ ওভার বল করে নিয়েছেন ৯ উইকেট। দিয়েছেন তিন মেডেন ওভার।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ডান হাতি ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমদের বেশ ভক্ত আঁখি আক্তার। এজন্য তাসকিনকে নিজের আইডল হিসাবে নিয়েছেন। তারও ইচ্ছা তাসকিনের মতো জাতীয় দলে খেলার। এজন্য অবশ্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন লক্ষ্মীপুরের এই নারী ক্রিকেটার। লক্ষ্য বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরনের মাধ্যমে জেলাবাসীর মুখ উজ্জল করা।
নারী এই ক্রিকেটারের মা নাহার বেগম বলেন, ছোটবেলা থেকেই আঁখি শান্ত প্রকৃতির, সৎ ও পরিশ্রমী ছিলেন। যেকোন কাজ মনোযোগ দিয়ে করতো সে। সমাজের মানুষের হাজারো অপবাদের পরেও মেয়েকে ক্রিকেট থেকে এক মুহুর্তের জন্যও দূরে রাখেননি তিনি। শুধু আঁখি নয় ছোট মেয়ে মুন্নি আক্তারও নিয়মিত ক্রিকেট খেলছেন বলে জানান। এজন্য আখি ও ছোট মেয়ের সফলতার জন্য জেলাবাসীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেছেন নাহার।
লক্ষ্মীপুর জেলা ক্রিকেট একাডেমীর কোচ মনির হোসেন বলেন, ভালো প্রতিভা দেখে বিনা খরচে প্যাকটিস ও ক্রিকেটের বিভিন্ন সরঞ্জাম উপহার দিয়ে খেলায় উৎসাহিত করেছেন আঁখিকে। বর্তমানে তার সফলতায় আনন্দিত এই কোচ। তার প্রত্যাশা অল্প সময়ের মধ্যেই জাতীয় দলে খেলবে এই নারী ক্রিকেটার।
Comments are closed.