হাসান রোবায়েতের কবিতা: রুজা

192


এই তো, আমারই পাশে যে রৌদ্রশিস ধরে উঠে গেছে শিমলতা—ক্রমশ
তাদের বক্রতা নিরর্থ এক শূন্যে গিয়ে শেষ হয়—তার ফুলের কাছে
আমারও বলার ছিল: —‘অতদূর উন্মীলনে তুমিও হতে পারো দণ্ডিত, অপার
বর্তুল—’

যেন প্রতিটা মরণশেষে ফুটছে কার্পাস—

তোমাকে ডাকছি, জান্নাত—চিরকাল ঢেউ দিয়ে চলে যাও বিরহী ঘুঙুর

শালঢেউ—
নুয়ে আছে ট্রেনের ওপার
তার চোখহাসি প্রভূত তাসের চাল
হাওয়ার মর্মের ধারে
ঝরে যাচ্ছে শাঁ শাঁ—

অন্ত্রকরোজ্জ্বল এই ছায়ায় তাকে ভাবি—
তার মৃত্যু-শিংহল কেশ,
তার গম্ গম্ মুখ
শিরস্ত্রাণ থেকে উড়ে যাচ্ছে পাখি
রক্তচমকের দিকে
এক জোড়া স্যান্ডেল ঝুলে আছে গোধূলির ভেতর—

তাকাই বিষণ্নতা—সমস্ত ফোকরসহ আত্মায়
ছোঁড়া হলো মূকাভিনয়
সূর্য অব্দি পেরেক
ভীড়-করা কন্যাটির পাশে
থক থক করছে পথ—সে তার জিভ দিয়ে
বাঁকিয়ে দিচ্ছে হাসি
ক্ষমা করছে শরীরসমগ্র মাংসকে—
সে এক রমনীর স্তুপ
চোখ: গাঢ়তর প্রভু
গুজবের মতো স্তন—

কর্তব্যহীন রেল যেমন বেঞ্চি দেয় রোদকে, ফুটে ওঠার জন্য যথেষ্ঠ ফুল—
আমাদের বক্ষমান রমনীও খাঁ খাঁ ভর্তি করে পাঁজর যে মুদ্রায় লেগেছিল
দারুণ দৈবচয়ন তাকেও ডেকেছিল অধীত ‘কুকুর’—

আত্মহত্যার বোন চুমু করে টোলের উপর—
ডাকি তাকে—শুধাই কুশল—তুমি কি
মেয়েভালো হাওয়া?
বাতাসের হৃদয়ে গিয়ে টুং টাং বাজাও আদল?

মাঠ জুড়ে টেবিলক্লথের শাদা, শিশুর হাসির অণুমন—

সে-ও চলে যায়—

দিনমান নড়ছে কপাট
উড্ডীন শূন্যতার ভেতর

এখন, নিহিতার্থ বনে
গূঢ় যোগাযোগ ঢেউ থেকে উপঢেউ হয়ে
বাজায় অসহ প্রেম—

আমাদের দেখা হলো
মাছের অতিরিক্ত পেটে হীরা-কারবারিদল
মূখ্য এ বাতাসেও যেন পাতা
না কাঁপে কিছুতেই—এসব বন্যা-কৌশল
শেখা হলো গতরাত্রির নিচে, নিমবনে পড়ে থাকা পূর্ব-শতাব্দীর লোহায়—

সহসা স্তন্য ঘিরে
শিশুটির গোল ঠোঁট তোমাকে ডাকছে কাঠে
মাতৃমর্মর জলে—

বিবাহ-নির্ভর এই
হস্ত ও মৈথুনের মাঝে
উঠে গেল মদ-কল্পনা, উঠে গেল নুন-প্রকারের স্মৃতি

যেভাবে নগ্নতাও হতে পারে একটি মীমাংসা—

জান্নাত—একটি স্পষ্ট পাখির ডাক
মিহিন শর্করা প্রায়
উন্মাদেরও থাকে সমুদ্র-শোকের ভার
চিরকাল ভাসমান এই ঘামে
যে গৃহস্থ দেখে নেয় সচ্ছল বায়ু
তারও মদ ফেটে গেছে কর্কট রাশির ভারে

যেন তুমি—সহসা ফেনার কাছে শূন্য এক গান।

*
হে আমার নখের কুশুম কেন ঢেউ শেষে
অন্নভিক্ষার চেয়ে বেশি নয় হাওয়া!

মাটিও গৃহত্যাগী—
এমন শ্লেষে কতক স্তব্ধতা ছিলো
নিরক্ষর মেশিনের তল—কোনো কোনো ছায়ার থেকেও
দীর্ঘ হয় পাড়া—স্বতন্ত্র উদ্বেগ এই করচিত্রের অধিকার—

এখানে সমস্ত রাত্রি মহিষের দল
নিরর্থ মাঠের শেষে কূট পৃথিবীর
প্রবল লাবণ্য-শোরে নেমে আসে ধীরে
তাদের খুরের পাশে আজো কোনো স্থির

লাইট হাউজ থেকে দেখা যায় ডানা
ঘূর্ণমান নদীটির পাশে তিতি ফুল
সারসের এক ঝাঁক উড়ন্ত ছায়ায়
কোথাও কাঁপছে রুহ, তরণী উন্মূল—

তাদের দ্বীপ কি খর? অতি-সামুদ্রিক?
যেদিন সূর্যের বনে নীল কণ্ঠস্বর
রেখে চলে যাও একা ফেন-অন্ধকারে
পাথরে বিশাল ঢেউ সুরম্য মর্মর

ভেসে ওঠে জলছিদ্র থেকে—যেন তার
নির্জনতা অশোকের প্রতিধ্বনি বেয়ে
সে কোন কালের এক লৌহ-ঝরোকায়—
হলুদ পাতার-তীরে, গভীর সন্দেহে

এই বিষ তোমাকেই ডাকছে, জান্নাত—
নিবিড় সোনাটা ভেঙে বহু কবুতর
যেন সারি সারি চোখ, স্ফুলিঙ্গ-উড়াল
ফেলে যায় আপামর ঘুমের ভেতর—

তারপর, যুদ্ধদিন, লাল নিস্তব্ধতা
ছিঁড়ে ফেলে বনঘুম, শিশুদের মুখ,
মৌ-শিকারির ব্যাথা—আসন্ন রাত্রিতে
শুনছি হাওয়ার ভিড়ে নিখিল চাবুক

এখানে মিডিয়োক্রিসি, অক্লান্ত স্টুপিড
বাস্তুনীল কোন গাঙে ঘুঘুদের শিস!
নোনা হাওয়া ঝরে যায় পাথরে, বেলায়
বিরহে মৃত্যুও দূর বিষণ্ন ট্রাপিজ—

মেয়েটার গলার ভেতরে বসে
দুর্ধর্ষ বসন্তকাল
ধীরে ধীরে পা নাড়ছে আর খাদ্যনালীর মাঝে আটকে আছে চাঁদ

এসেছি তোমার কাছে প্রত্যাখাত হতে একবার
যদিও তরঙ্গ জুড়ে বাতাসের চোখ, প্রতিধ্বনি—
জাগিয়ে রেখেছে উট, নীল স্বেদ, চোরাকারবারি
লোহার ফিনকি দিয়ে এখনো বিষাদ ঝরে কার!

ঝাঁক ঝাঁক উড়ো-পিচ তোমাদের সুরকির পথে
যেখানে ঝরার পাতা বিস্মৃত শাড়ির আঙিনায়
জানালা খোলার পর বহু স্তন ভেসে যায় রোদে
আমর্ম শিমুল ফুটে তুলায় উড়ছে পারাপার

যেভাবে পাতার নীচে কীটদের কথোপকথন
শোনা যায় অন্ধকারে তারপর পৃথিবী কোথাও
ছড়ায় নির্জন তার সমস্ত সন্তাপ ভুলে গিয়ে
অতটা বিদ্যুৎ আমি মেঘের ঘুমের মধ্যে আজো

তোমার ঘাসের দিনে দাবদাহে বেজে ওঠে গান
সেসব সুরের কথা কখনো কি শুনেছিল কেউ
দূরে, তোমাদের বাড়ি গুণ্ঠন-উন্মীলনে
ডাকছে রাত্রির চরে ঝিঁঝিঁদের মূক আলেয়ায়

যেন সে আফিম-পথ আমি একা হেঁটে গিয়ে দেখি
কেরোসিন তেলে ডুবে গোধূলিও অস্তমান প্রায়
পড়ে আছি দিকহীন: অমিত শূন্যের কোলাহল
সানুমান এই রোদে একাই থেমেছে হাওয়া-কল

এসেছি তোমার কাছে প্রত্যাখাত হতে একবার
দাও—টকটকে ছায়া, অমৃত শস্যের মায়াশোর

বিবাহের দিন শেষে
খাঁ খাঁ হাওয়া
কাঠের উপর দিয়ে নিয়ে আসে ট্রেনমাখাঋতু—
নিমিষে শ্রাবণ ফোটে মলিন সন্ধ্যাবেলা

আমার হীনমন্যতাও এতো বাঙ্ময়
কাঁপায় ধুনুরির গান

বিবাহের দিন শেষে তোমাদের বাড়ি
মনে হয়, দূরের তুষার—

মেয়েদের বিয়ে হলে পাড়ায় ঐ নামে আর কেউ থাকে না—

১০

আফ্রিকার চাঁদ কি সবুজ! সেইসব ফুলেদের কী হয় যাদের কেনা হয়েছিল
দয়িতার মুখের সাথে মিলিয়ে অথচ গ্রহণ করে নি কোনো হাত!

প্রেম, দাঁড়িয়ে আছে লাল সুরকির পথে—অজস্র মোরগের কণ্ঠ দাউ দাউ
করছে হাওয়ায়

১১

ফিরে এসে, বলো—

লাল-ইট বাড়িটার পিছে
জবার কাঁপছে হাওয়া—
তুমি, চলে গেলে কাঁচা ওম সাথে করে
পদ্মপাতায় তার গড়িয়ে আদল—

সে মরণ: চাঁদের নিচে ফুটে আছে জিরাফের ডোরা

ফেল্টের অভিভূত বনে
পায়েলের
বেজে যায় রিমঝিম

যেন অন্ধ এক ইমেজের মধ্যে তুষার উড়ছে সারাদিন

১২

জানালা খোলার দিনে তুমি খুব ভোর হয়ে যাও—

খরগোশ নগ্ন হতে হতে
খুলে ফেলে বন

রোদের কোয়ায় হেলে পড়ে মুমূর্ষু ছায়া
এই বনভূম, সুমিষ্ট কাঠের স্নান
স্যাংকচুয়ারির দিনে তুমিও বেছে নাও কমলাফুলের শিস

নীল ফুল সত্যি কি নীল হয়ে ফুটে আছে পিঁপড়ের পাশে

১৩

তারচেয়ে, এই হেম অন্ধকারে
অক্ষত জমিটির উপর
তোমার পড়ে থাকা নথ—ভাবো, খোঁজার ছলে—

চেয়ে আছি জামিরের ব্যাকুল বনে

শীলাবতী চোখ:
পৃথিবীর প্রতিটি হুইসিল
ঘুমিয়ে পড়ছে অন্ধকারে
বণিকের নির্জনতা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে
ঢেউয়ে—

চলো, আদিগন্ত হাঁসেদের মধ্যে গড়িয়ে দিই
প্রবল অস্তাচল—
উড়ে যাক দণ্ডিত ভঙ্গিমা বুদ্ধের অহং-তীরে

সে আসে মরণ নিয়ে জামের ভরাট নীলে

পাতার গুণ্ঠন
ঝিলমিল করে হাওয়ায়—

১৪

নতুনের দিন চলে যায়—

সারা বাড়ি
তোমার বিরহ এলে ভেসে থাকে শাড়িটির ওড়া
দহলিজে
দাঁড়িয়েছো প্রেম, না বাসা ভালোয়—
কে যেন আলোর উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে শিমফুল

এ ইশক, দরগার ধুলা: বিরহের চিরক্রীতদাস—

১৫

এখানে, সমস্ত আকাশ-ভরে পড়ে আছে
পোস্টঅফিসের হাসি—

ভূয়সী পাগল কোথাও গান গেয়ে
নগ্ন করছে হাওয়া
যেন এক খরগোশ নিজের সমুদ্র কাঁধে
দৌড়ে যাচ্ছে ঢেউয়ে—

সারা বাড়ি নিষ্পত্রের ধু ধু—
খরতর বৃষ্টি পড়ে তোমাকে পাওয়ার ওপার—

আরও পড়ুন

Comments are closed.