প্রিয়তমো, সুন্দর সময় চলিয়া যায়

367


মাজহার সরকার

১.
আজ সন্ধ্যায় সাতটি রাজহাঁস আমার বুকের ভেতর ডুব দিয়ে পালিয়ে গেলো
সাতটি পাখার উষ্ণ অধ্যায়ে সবুজ পালক থেকে ঝরে পড়ে তৃষ্ণার জল
ত্বকের ভেতর ভূমিকম্প আর চোখের আয়ুতে উজ্জ্বল
আজ তোলপাড়, শিরা উপশিরায় লাল লোহিতের ঢেউ
কোন লোকে কোন চরে, কার আঙুলে নীল শব্দের চাবি ওঠে বেজে?
আজ সন্ধ্যায় সাতটি রাজহাঁস আমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে উড়ে গেলো
সাতটি নখের চুমুতে বুকের স্তব্ধ বাগান থেকে মিথুন ফল ছিঁড়ে নিয়ে
সেই শোভা আর তার মুখ প্রগাঢ় চুমুতে নির্মাণ করতে আজ এই
উৎসবে, সাতটি রাজহাঁস আমার বুকের রক্ত পান করে চলে গেলো
আজ সন্ধ্যায় পাঁজরের জানালায় তারা ডেকে ডেকে অভিষিক্ত হলো
রাতের কাতরতা ছুঁয়ে। আমি কি আর একবার তাকিয়ে দেখবো
বাসনারা অন্তিম দুঃখ নিয়ে কি করে দু’ঠোঁটে জমা রাখে চুমুর দাগ!
এই বিভক্ত পৃথিবীতে এই খণ্ডিত মানবিকী সময়ে এই রুগ্ন ইতিহাসে
আমাদের প্রেম কি সইবে ডানার আঘাত?
আহত আঙুল থেকে ঝরে পড়বে শোক!
আজ সন্ধ্যায় সাতটি রাজহাঁস কুরেকুরে খায় আমার বুকের মাংশ
সাতটি ডানায় উমের পালক ছড়িয়ে চারদিক ঘিরে মিলে ছিঁড়ে খায়
প্রার্থিত সোনালি আপেল।

২.
কখনও কি ছুঁয়েছি তোমাকে? তাহলে
এই আনত আঙুলগুলো কেন
হাতের খেলা ফেলে দশবার অভিনীত
স্থির থেকে কেঁপে ওঠে, কেন
স্পর্শ লেগে থাকে না, কেন থাকে না চিরদিন
দশটি আঙুলে তোমার শরীরের ঘ্রাণ!
ছুঁইনি আমি! ছুঁয়েছি সে পাঁচ বছর আগে
খুব বেশি কি হলো! এরপর বিছানায় স্মৃতি ও
তোমাকে ফেলে রেখে এসে
একা
শরীর এসেছে হেঁটে
আঙুল শুঁকেও তোমাকে আর পাই না
আঙুল কেন রাখে না স্মৃতি
পাই না ডানার ঘ্রাণ লাল তার কণিকা!

৩.
কে তবে হনন করে আকাঙ্ক্ষার গোপন থেকে!
প্রিয়তমো, ধূসর অপেক্ষা থেকে নেমে আসো এই ক্ষমা
মাটির বর্ণের মতো এই মুখ
আগুনের ঋণ থেকে আলাদা করা খড়ের ভেতর
স্রোত, প্রসবে একাকী তোমার গাভী।
অনাদ্র পাথর থেকে মাছের প্রতিভা হয়ে একা
মৃত্যুচিহ্ন থেকে ফিরে গেছো বীজে।
কখনও সংকেত কখনও বিস্তার থেকে এসে
ছাই থেকে ফেরাও তুষের মগ্নতা
চাদর থেকে ফেরাও শীতের রক্ত
আজ আমাদের রোপিত ছায়া উড়ে যায় আলোর কৃষিতে
প্রিয়তমো, সুন্দর সময় চলিয়া যায়
কাঁচ ছুঁয়ে শুধু হাত কেটে যায়, ঠোঁটের কিরিচে ঝরে যায়
প্রজ্বলিত সেঁজুতি। প্রিয়তমো, রাত তো যায় না
মিষ্টি যা লাগছে, এমন রোজ কেনো হয় না!
হেসে হেসে হাওয়া ভরে খেলাও তোমার খেলনা।

৪.
অনেক বড় হয়েও আমি জানতাম কেবল চুমু খেলেই পেটে বাচ্চা হয়ে যায়। যেসব বিষয় ছেলেরা অনেক আগেই জেনে বসে আছে, আমি থাকতাম সর্বশেষ ব্যক্তি যে এইমাত্র এসব জেনেছে। একদিন একটা মেয়েকে চুমু খেলাম। সে বললো, জীবনটা ছেলেখেলা নয়। আমি তাকে অন্য গালে আরেকটা চুমু খেয়ে বললাম, দয়ালু বাঘ বলতে কিছু নেই। মেয়েটি আমাকে তার স্তনের ওপর টেনে নিলো। বললো- ওই যে কামরাঙার ডাল, তার নিচে আমাদের সব উৎকণ্ঠা পুঁতে রাখবো নিরাপদ বিশ্বাসে। আমরা হেঁটে যাই শহরের কিনারে, যেখানে সূর্য এসে অস্ত গেছে আমাদের শরীরের ওপর। আসলে সূর্য কখনও অস্ত যায় না, পৃথিবী ঘুরে যায় মাত্র। না দেখতে পাওয়ার নামই অস্ত। মেয়েটি বালুতে শুয়ে পড়ে কবিতা লিখলো, আমি পাথরের উপর বসে। তারপর হেসে ফেলে একে অপরের কবিতা টেনে নিয়ে পড়লাম। চুমু খেলাম, গোল হয়ে হাত ধরে নাচলাম। লুকিয়ে গেলাম পাহাড়ের আড়ালে। আমি জানতাম কেবল জড়াজড়ি করলেই বিয়ে হয়ে যায়।

৫.
আজ তার মৃদু দেহ মৌসুমির মতো
আকাশের নীল যেন পৃথিবীতে ঝরে
যে পাখি নরোম ডানায় তার উড়ে যায় প্রভাতী বাতাস
দিনরাত প্রস্তুতির গান
দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে
মুছে দিতে প্রতীক্ষার অশ্রুময় লেখা
সেখানে আজ তাকে অস্তিত্বের মতো ঘনিষ্ঠ জেনে
দ্রুত পায়ে চলে যেতে দেখি হৃদয়ের ভার বয়ে
আজ তার মৃদু দেহ উদয়ের মতো
মুগ্ধ শিশিরে রোদের হীরক, অস্তমান সূর্যের সোনায়
হেনেছে শুধু বেদনার রাত উতল নির্জনে।
জীবনকে মনে হয় নীরব সঙ্গীত
পৃথিবীর চিত্রশালা শূন্য হয়ে যায়
এসবে আছি রমণীর রক্তের মতো নিজ সন্ধ্যায়
আজ তার মৃদু দেহ সোনার শরীর
রূপালি মাছের মতো সহজ ইচ্ছায় শুয়ে সেই একজন।

৬.
খুলে দেখলাম, ভাঁজ করেও দেখলাম
আমি তাকে আগলায় দেখলাম
মুহূর্তের চকিত বিস্ময় জলে চকিত মাছের
রক্তিম নিলয়ে রক্ত ধমনীর পরিখায় ঘেরা
অগণ্য শ্বেত সিপাহী কণিকার
নিবিড় প্রহরী স্নায়ুর মর্মর দুর্গে দেখলাম―দেখলাম
হ্রদের বুক থেকে তাকায় উল্লসিত বাঘ।
পাহাড়ের নখ চিরে বনগাছের তলে
জনপদে, এখন কে আসে সোনালু শস্যের ময়দানে অলস হেমন্তে
কৃষকেরা মাথায় ফসল নিয়ে চলে
খালি পা কৃষাণকামিনী সন্ধ্যার দীপ হাতে আনত কুটিরে
এ সবই প্রাচীণ গঙ্গোত্রীর স্রোত
নিহনন ও নির্মাণের কথা, শুনলাম
ভেতর থেকে আমি তাকে হো হো করে নিয়ে যাবো
তাকে বুঝি হাতের রেখায় তুলে নিবো―আর
আতঙ্কিত বোকা প্রহরী বালুর উপর উঁচুমুখ উট
আমি দেখলাম―মেঘের উপর দিয়ে ধাবমান―ধাবমান

৭.
চিরকাল ভালোবেসে ঘর ভাঙবার প্ররোচনা নিয়ে
আকাঙ্ক্ষিত কুসুম যদি জেগে ওঠে বলয়ের পারে
আর তার তীর বিদ্ধ করে হিমের দেয়াল
সর্বরিক্ত প্রাঙ্গণ জুড়ে বর্ষার প্রথম কদম
ছড়ায় হাসির ছটা, প্রত্যাশার কাছে ব্যর্থতা তুলে দিয়ে
আমি আর কোন প্রীতি নিয়ে রাস্তায় ঘুরবো?
দুই চোখে ঘুমহীন রাত নিয়ে অসহ সময় গুণে
সোনার কাঠির স্পর্শে খুশির অপেক্ষমাণ বিদ্যুৎ
মানুষের অশ্রুর চোখে, মানুষের রক্তের দোষে
আমি আর কোন সম্ভাবনার প্লাবন এনে অভিষিক্ত হবো?
আমার যা কিছু দেখে হিংসে হয় সব নিয়ে যাও
বিষয়-আশয়, আসবাব, ফুলের বাগান, গৃহের পশু
আকাশের নীল চোখ নিভে যাও যুবতী পাখীর মুগ্ধ বেদনায়।

৮.
আমি ল্যাজারাসের মতো মৃত্যুকে ঠকিয়ে এসেছি
আমি হা হা করে হেসে ওঠি, পরক্ষণেই বিপুল অসহায় বোধ করি
আমি মরে গেলে যদি একটি কুকুরও কাঁদে
আমি তাকে লাথি মারবো
কিছু কুকুর আমাকে কি স্পর্শ করেনি!
আমার কখনও ঘর ছিলো না, ঘরে ফেরার তাড়া ছিলো না
বেশি টাকা হাতে এসে গেলে বিব্রত লাগে আমার
প্রশংসা শুনলে নিজেকে লিঙ্গান্তরিত নারী মনে হয়
কেউ ফোন দিলে মনে হয় এই বুঝি আমার শয্যা কামনা করবে
পায়ুকামে নিবৃত্তি নেবে সমাজের গভীরতর অসুখ।
এই জীবনে সমর্পণ শিখিনি
চিরকাল ভেঙেছি শুধু, কোন নারী দশ মাস আমার বীর্য
পেটে লালন করে বেড়াবে ভাবতেই আমার অবশ লাগে।
যুবতীরা গোষ্ঠীপিতার আশীর্বাদ নিয়ে
স্তনে ও জঙ্ঘায় বিবাহ রাত্রির ক্ষতে
চারপাশে ক্লীন্ন কদর্যতা দারুণ সংবর্তের ভেতর সারা শরীরে আমার
লাল লাল কামড়, অশ্লীলতার জ্বরে শহরের চোখ লাল।

৯.
ছোটবেলায় এক ফুলগাছ কিনেছিলাম। বারান্দার টবের কাছে চেয়ার পেতে সারাদিন বসেছিলাম কখন ফুটবে ফুল! কখন! মা-বোনরা হাসাহাসি করেছিল। কিন্তু ফুল আর ফোটে না দেখে গাছটাকে নার্সারির লোকটার কাছে ফেরত দিয়ে এসেছিলাম। লোকটা হেসে ফেলে একদিন কতো না ফুলের প্রেরণা থেকে মানুষের মনোযোগে টবটা ফেরত নিয়েছিল। আমার এখন অবসর নেই ফুল ফোটার প্রতীক্ষায় থাকার। একটা চিনির দানার কাছে তার একাগ্র রসকুসুমে একসারি পিঁপড়াকে বহুদূর ঘুরে হেঁটে যেতে দেখে এই সেদিন জানলাম, নক্ষত্রের দূরত্বে আজ আমার অবস্থান। কোন অপেক্ষা ফুলের অধিকারে নেই, এমন কেউ নেই এই ছলনা-আকীর্ণ শহরে নিষ্ক্রমনপ্রিয় নারী আর বন্ধু শুধু। ফুল ফোটে না আজও মানবিক তৃষ্ণার ওপর। তোমরা যাকে উৎস করো, যাকে সুলভ শুভেচ্ছার প্রার্থী করো সুহৃদ শুভার্থী ফুল ছোঁবে না কখনও। ফুলগাছ ফুল না দিয়ে কি সহজে ফিরে গেছে নিজস্ব বাগানে!

১০.
গেছে রাতে খুব কাছে গিয়েও ছুঁতে পারিনি। আমার সবটুকু সুখ পিছলিয়ে গেলো। যতবারই ভালোবাসতে গেছি কেউ না কেউ কিছু না কিছু নষ্ট করে দিয়ে গেছে। এতো কাছাকাছি এসে হাত বাড়ালেই নাগাল পাই বলে তৃষিত লোভে রক্তে মরি। আরেকটু, হয়ে গেছে হয়ে গেছে। এসে গেছি প্রায়। এইতো পেয়ে গেছি খোঁজ! বসন্তের এই প্রান্তে আজ আমি সব কিছু পেতে যাচ্ছি। কিন্তু না! প্রচণ্ড সুখের শীতে বেহায়া জিহ্বা যেন এক মাতাল যন্ত্রণায় বহে। তবু মানুষ বলে- সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে। অনেক প্রশ্ন, স্লোগান, সংঘর্ষ, যতো আশ্চর্য চিহ্ন সামনে। ঠোঁটের কাছেই ফিসফাস করে। তবু দরজা খোলে না। ভালোবেসে বেসে আমি ভালোবেসেছিলাম তার থুতু। চেটে দেখি থুতুতে কাহিল জ্বালা। একদিন তাকে আরও কাছে আমি চেয়েছিলাম। সে চলে গেলো, চলে গেলো আর বলে গেলো- ‘আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি’। এতো কাছে এসেও আমাকে দুঃখ পেতে হবে। প্রেমিকার ফর্সা হাতের কাছে সান্ত্বনা নিয়ে বারবার ফিরে যেতে, যতোবারই ভালবাসতে গেছি কেবলই কষ্ট পেয়েছি।

আরও পড়ুন

Comments are closed.