ফেনীতে অনলাইনে জমজমাট রসের হাট
‘শীতের যশ, খেজুরের রস’ আবহমানকাল ধরে চলে আসা এ প্রবাদটি আজও প্রাসঙ্গিক। এ রসে গলা ভেজাননি এমন বাঙালি কমই আছেন।
প্রকৃতিতে এখন শীতের দাপট, কদর খেজুর গাছের। শহরে স্বাদের এ রস যেন সোনার হরিণ। গ্রামেও সহজে মেলে না দেখা। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামগঞ্জ এমনকি শহরের পরিত্যক্ত খেজুর গাছ কাটার ব্যবস্থা করে রস সংগ্রহ করছেন ফেনীর একদল নতুন উদ্যোক্তা। গাছিদের কাছ থেকে সরাসরি রস সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি করছেন তারা।
নিজস্ব তত্ত্বাবধানে খেজুরের রস সংগ্রহ করে ভোজনবিলাসীদের চাহিদা মেটাচ্ছেন তারা। অর্ডার পেলে রস পৌঁছে দিচ্ছেন ঘরে ঘরে। অর্ধ শতাধিক তরুণ উদ্যোক্তাসহ কয়েক শতাধিক মানুষ ব্যস্ত সময় পার করছেন মৌসুমি এ ব্যবসায়। অনলাইনে রসের এ হাটে দৈনিক বিকিকিনি হয় লক্ষাধিক টাকার। অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে পুরো মৌসুম রসের এ বাজার প্রায় অর্ধকোটি টাকার।
উপকূলীয় জনপদ সোনাগাজীর আদর্শ গ্রামের যুবক রহমত আলী। বছরের অন্য সময় ভিন্ন ব্যবসা করলেও শীতের পুরো মৌসুমে ব্যস্ত থাকেন রসের ব্যবসায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে গত মৌসুমেও সাড়ে তিন লক্ষাধিক টাকার খেজুররস বিক্রি করেছেন এ যুবক। চলতি মৌসুমে বিগত মৌসুমের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করার লক্ষ্য তার। এলাকার দেড় শতাধিক গাছ থেকে প্রতিদিন রস সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছেন শহরের মানুষের ঘরে ঘরে।
রহমত বলেন, সব ঠিকঠাক থাকলে চলতি মৌসুমে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকার রস বিক্রি করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।
রসে যাতে ইঁদুর-বাদুড় মুখ দিতে না পারে, নিপাহ ভাইরাস ছড়াতে না পারে সেজন্য নেট দেওয়াসহ বিশেষ নিরাপত্তার কথাও জানিয়েছেন এ অনলাইন উদ্যোক্তা।
শুধু এ একজন নয়, ফেসবুক পেজ সহজ বাজারের রাশেদ, ই-ফাতাহ’র নিশাদ ও হ্যালো কলের হান্নানসহ এমন আরও বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা অনলাইনে রসের হাট জমিয়ে তুলেছেন। ভোরে গ্রামে গিয়ে গাছিদের কাছ থেকে রস সংগ্রহ করে পৌঁছে দিচ্ছেন শহরের মানুষের ঘরে ঘরে।
সহজ বাজারের রাশেদ জানান, অনলাইনে তারা ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন। মৌসুমে রস বিক্রি করে আয়ও সন্তোষজনক।
ই-ফাতাহ’র নিষাদ বলেন, সময় পাল্টেছে, অনলাইনের বদৌলতে মানুষ এখন সব পাচ্ছে হাতের মুঠোও। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্ভেজাল খেজুর গাছের রস আমরা নিয়ে এসেছি মানুষের দোরগোড়ায়।
বছর কয়েক আগেও এখনকার মতো রস বিক্রি হতো না। নিজেরা খেয়ে যা বাঁচতো তা দিয়ে ঝোলাগুড় তৈরি করা হতো। দাম ছিল না তেমন। হালের অনলাইনের আবির্ভাবে রস বিক্রি করে লাভের মুখ দেখছেন প্রান্তিকের মানুষগুলো।
ষাটোর্ধ্ব কবির আহম্মদ বলেন, আগে খেজুর গাছের রস তেমন বিক্রি হতো না। এখন অনলাইনের কারণে রস একটুও থাকে না। সব বিক্রি হয়ে যায়।
শহরের বাসায় বসে একদম গ্রাম থেকে আসা খেজুরের রস খেতে পেরে উচ্ছ্বসিত ভোক্তারাও। খরচ একটু বেশি হলেও তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন তারা।
শহরের মাস্টারপাড়া এলাকার বাসিন্দা জহিরুল হক বলেন, এটা সত্যিই ভালো লাগার। সেই সোনাগাজীর আদর্শগ্রামের রস ফেনী শহরে বসে টাটকা খাওয়া- এটা সৌভাগ্যের।
অনলাইনে বিপণন বাড়ায় বেড়েছে খেজুর গাছ রোপণ ও রস আহরণ। সোনাগাজী উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, পুরো উপজেলায় ৩০ হাজারের বেশি খেজুর গাছ রয়েছে। তার মধ্যে রসের জন্য কাটা হয়েছে ১৮ হাজারের মতো। সরকারিভাবেও বিতরণ করা হচ্ছে খেজুর গাছ।
সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহমেদ (সোহাগ) বলেন, খেজুর গাছের রস বর্তমানে একটি অর্থকরী বিষয় হয়ে উঠেছে। অনলাইনের কারণে বিপণন বেড়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখে এ বিষয়ে কৃষি বিভাগও নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে।
অনলাইন উদ্যোক্তাদের আশা, চলতি শীতের মৌসুমে ২৫ লক্ষাধিক টাকার খেজুর গাছের রস বিক্রি করবেন তারা। অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে পুরো মৌসুমে শীতের এ রসের বাজার ফেনীতে প্রায় অর্ধকোটির। ডিজিটালের ছোঁয়ায় ঐতিহ্যের এ অনুষঙ্গ গ্রামীণ অর্থনীতির পালে লাগিয়েছে হাওয়া।
Comments are closed.