শহীদ বুদ্ধিজীবী চাটখিলের অধ্যাপক মুনির চৌধুরী
হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হন
১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রহরের এই দিনে হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন দেশের অগ্রণী কিছু মানুষ। আর এক দিন পরই ১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ৯ মাসের স্বাধীনতাসংগ্রামে লক্ষ–কোটি নারী–পুরুষের আত্মত্যাগ আর সমগ্র দেশবাসীর অবর্ণনীয় দুঃখ–কষ্টের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তাই ৪৯ বছর আগের এ দিনটি আমাদের কাছে একাধারে অনেক দুঃখ আর বেদনার এবং অনেক আনন্দ ও বিজয়েরও।
এই ১৪ এবং ১৬ ডিসেম্বর এলেই আমাদের স্মৃতিতে ৩০ লাখ শহীদের সঙ্গে ভেসে ওঠে বিশেষ একটি নাম। তিনি হলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষ, আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন তিনি। চাটখিলের কৃতি সন্তান অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার–আলবদর বাহিনীর সদস্যরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
যদিও আমরা ১৪ ডিসেম্বরই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, শুধু সেদিনই যে বুদ্ধিজীবীদের বাসাবাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, তা নয়। দেশের সেরা এই মানুষটিকে ১৯৭১ সালের ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ঢাকা শহরে কারফিউ চলাকালে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা পরিকল্পিতভাবেই এই বুদ্ধিজীবীর ওপর নিধনযজ্ঞ চালিয়েছিল।
শিক্ষাবিদ, নাট্যকার ও সাহিত্য-সমালোচক শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-১৯৭১)। পুরো নাম আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। তিনি তৎকালীন ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন গোপাইরবাগ গ্রামে। বাবা খানবাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরী ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯৪১ সালে মুনীর চৌধুরী ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে বিএ অনার্স (১৯৪৬) ও এমএ (১৯৪৭) পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলায় এবং ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন খুলনার ব্রজলাল কলেজে (বিএল কলেজ) অধ্যাপনার (১৯৪৭-৫০) মাধ্যমে। পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (১৯৫০) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ও বাংলা বিভাগে (১৯৫০-৭১) অধ্যাপনা করেন। শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে মুনীর চৌধুরী বামপন্থী রাজনীতি ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড এবং পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সভায় তীব্র ভাষায় বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে নিরাপত্তা আইনে সরকার তাঁকে বন্দি করে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। পরে তিনি আরো দুইবার বন্দি হন। জেলে বন্দি অবস্থায়ই তিনি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় রচনা করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘কবর’ (১৯৫৩)। ১৯৬৫ সালে তিনি উদ্ভাবন করেন বাংলা টাইপ রাইটারের কি-বোর্ড, যা ‘মুনীর অপটিমা’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে তিনি পাকিস্তান সরকারের দেওয়া সিতারা-ই-ইমতিয়াজ (১৯৬৬) খেতাব বর্জন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগীদের দ্বারা অপহৃত ও নিহত হন।
Comments are closed.