ইতিহাসের কিংবদন্তি ড. কামাল হোসেন

188
ড.কামাল হোসেন

একটি সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশকে কর্মক্ষম করে তুলতে কিংবদন্তির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসও অভিন্ন নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে ড. কামাল হোসেন ঠিক তেমনই একজন ব্যক্তি। ৩৫ বছর বয়সে তিনি একটি স্বাধীন দেশের প্রথম আইনমন্ত্রী হন। প্রণয়ন করেন সংবিধান। কামাল হোসেন একাধারে একজন প্রখ্যাত আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা।

 

১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল বরিশালের শায়েস্তাবাদে জন্ম নেন তিনি। জমিদারবাড়ির এই চিকিৎসকের খাজনার টাকায় বিলাসী জীবন ভালো লাগত না। কলকাতার আরেকটি বাসা ছিল চৌরঙ্গীতে। সেখানেই জমালেন ডাক্তারি পেশা। এর ভেতর পৃথিবীতে নেমে এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই দামামার তোড়ে সপরিবারে চলে আসলেন বরিশালে।  ৪৭-এর দেশভাগের পর কামাল হোসেনের বাবা চলে আসেন ঢাকায়। সেন্ট গ্রেগরীজ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন কামাল হোসেন। ঢাকায় বেইলীরোডে তাদের বাসার নাম ছিল গুলফিশান। সেন্ট গ্রেগরী’জ থেকে আইএতে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি নিয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে, তখন ১৯৫৩ সাল। তখন সাধারণত জাহাজে চেপেই যুক্তরাষ্ট্র যেতো মানুষ। কিন্তু গিয়েছিলেন উড়জাহাজে। কামাল হোসেনের বিদ্যাবুদ্ধির দীপ্তি এতটাই তীব্র ছিল যে ইন্ডিয়ানার নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরাসরি তৃতীয় বর্ষে পাঠিয়ে দেন। যেখানে সহপাঠীদের বয়স ছিল ১৮-১৯ সেখানে কামাল হোসেন ছিলেন ১৬ বছরের এক তরুণ।

 

এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি কামাল হোসেনকে। ১৯৫৭ সালে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৮ সালে ব্যাচেলর অব সিভিল ‘ল’ ডিগ্রি লাভ করেন। লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল’ অর্জনের পর আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি করেন ১৯৬৪ সালে। ছাত্রজীবনের গোড়া থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়। চুয়ান্ন সালে তিনি পাকিস্তানি ছাত্র সমিতি করতে গিয়েছেন। গিয়ে দেখেন সেখানে বাঙালি মাত্র পাঁচ-ছয়জন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে মানিক মিয়ার বাসায়। সেই ১৯৫৪ সালে। ঐ বাসাটি এখন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের ‘মোসাফির ভবন’ হিসাবে পরিচিত।

রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সবসময়ই সোচ্চার। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান তার জেতা দুইটি আসনের একটি কামাল হোসেনকে দিয়ে দেন। তখনই প্রথম কামাল হোসেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পান। একই বছর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কামাল হোসেন শুধু আইনমন্ত্রীই হলেন না, তিনি রাষ্ট্রের নতুন সংবিধান তৈরির জন্য গণপরিষদ গঠিত কমিটির চেয়ারম্যানের পদও পেলেন। এর মাত্র বছর দুই পর তিনি পৃথিবীর অন্যতম কনিষ্ঠ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের স্পেশাল রিপোর্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। পচাত্তরের ভয়াল ১৫ই আগস্টে তিনি ছিলেন যুগোস্লাভগিয়ায়। সেখান থেকে তিনি যান লন্ডনে। খন্দকার মোশতাক চাচ্ছিলেন, কামাল হোসেন দেশে ফিরে তাদের সঙ্গে দলে মিশে যাক। কিন্তু তা করেননি তিনি। চলে গেছেন লন্ডনে। তেঁজগাও বিমানবন্দরে ১৯৭৫ সালে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে যখন দেশ ছাড়বেন তখনই বাঁধা দেয়া হয় তাদেরকে। জেনারেল ওসমানীর হস্তক্ষেপে তিনি ঘণ্টাখানেক বিলম্বের পর যাওয়ার সুযোগ পান। আইন পেশায় ড. কামাল হোসেনের প্রিয় বিষয় সমুদ্র আইন, জ্বালানি, তেল ও গ্যাসবিষয়ক আইন ও বিরোধ নিরসন।  কামাল হোসেনের জীবনের বড় মামলাটি ছিল ইত্তেফাক মামলা। ঐ রায়ে তিনি হারান সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাবা আলী কাসুরিকে। এরপর সেই মামলা যায় সুপ্রীম কোর্টে। প্রখ্যাত আইনজীবী একে ব্রোহির জুনিয়র ছিলেন কামাল হোসেন। ব্রোহির সঙ্গে আইয়ুব খানের একটি পদক্ষেপ অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে রায় দেয় আদালত। ওই মামলায় জিতে যান কামাল হোসেন। সেটি কামাল হোসেনের আইনি জীবনের অন্যতম বড় ঘটনা। ঐ রায়ে মন্ত্রিত্ব হারান দেড় ডজন মানুষ। ২০১০ সালে বিশ্ববিখ্যাত তেল কম্পানি শেভরনের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্যাস-সংক্রান্ত একটি মামলায়ও বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনেন আন্তর্জাতিক আদালত থেকে। বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকবেন আর জেল খাটবেন না তা কী করে হয়! তিনি জেল খেটেছেন ২ বার। ১৯৮৩ সালে তাকে শেখ হাসিনাসহ চোখ বেঁধে ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ৭১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে রাখা হয়েছিল তাকে। জেলে তিনি পেতেন একবাটি ডাল ও রুটি, কখনো ভাত। ৯ মাসে একটি খাতা ছিল তার রাজনৈতিক জীবন লেখার একমাত্র খোরাক। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ২৮ ডিসেম্বর পিন্ডির সেহালা জেলে। সেখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর আইনজীবী হিসাবে কামাল হোসেনের নাম বললে হেসে ওঠেন বিচারকরা। এ কে ব্রোহিকে দেয়া হয় আইনজীবী হিসাবে।   ড. কামাল হোসেন নারী নেত্রী ও মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেনের সঙ্গে ১৯৬৫ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রেমের বিয়েই ছিল তাদের। ৬২ সালে প্রথম দেখা নিউ ভ্যালুজ ক্লাবে। আওয়ামী লীগের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ড. কামাল হোসেন ’৮১ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। ১৯৯১ সালে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবং ড. কামালের মধ্যে।  ‘নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে’ বক্তব্য দিলে মূল নেতৃত্বের সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে। এ সময় কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ ছেড়ে গঠন করে গণতান্ত্রিক ফোরাম। ’৯৩ সালে দলের নাম থেকে ‘তান্ত্রিক’ শব্দ ফেলে দিয়ে গণফোরাম করেন। অবসরে তিনি সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। সত্যজিৎ রায়, তারেক মাসুদের প্রায় সব সিনেমাই তার দেখা। কামাল হোসেনের দুই মেয়ে সারা হোসেন ও দিনা হোসেন। তাদের দুইজনের স্বামীই ব্রিটিশ। দিনা এবং তার স্বামী দুজনই চিত্রপরিচালক। অন্যদিকে সারার স্বামী ডেভিড নিউজ এজ পত্রিকার সাংবাদিক। ড. কামাল হোসেনের জীবনের আরেকটি বড় সাফল্য হলো জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বীকৃতি। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ক্লান্তিহীনভাবে চেষ্টা করে গেছেন যেন বাংলাদেশের এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি জোটে। সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবারো জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে ড. কামাল হোসেনের নাম। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’ নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এই ঐক্যে ড. কামালের সঙ্গে যোগ দেন  সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাসদের একটি অংশের আ স ম আব্দুর রব এবং নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না। ৫ বছর আগে যে বিএনপি নির্বাচন বয়কট করেছিল গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে তারা পুনরায় নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ৮১ বছর বয়সী এই মানুষটির বর্ণাঢ্য জীবনের নানা কাহিনী একটি ক্ষুদ্র লেখায় তুলে ধরা দুস্কর। তাঁর কাজ বাংলাদেশের ইতিহাসকে সাফল্যমণ্ডিত করেছে।

আরও পড়ুন

নির্বাচনে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন সহকারী প্রোগ্রামার,ইউআইটিআরসিই, ব্যানবেইস মো.জহির উদ্দিন।

নারায়নপুর আর কে উচ্চবিদ্যালয়ের কমিটি গঠন,আবু তালেব সদস্য নির্বাচিত

এ সময় বক্তারা আদালতের রায় ও ডাক্তারের চিকিৎসা পত্র বাংলা ভাষায় লিপিবদ্ধ করার জন্য জোরালো দাবি জানান।

চাটখিল কামিল মাদ্রাসায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত

অল্পদিনের মধ্যেই এখানকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো অন্যায়, অবিচার, অনিয়ম ও চাঁদাবাজ আমার কাছে প্রশ্রয় পাবে না।

নিজ এলাকায় জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন এইচ এম ইব্রাহিম এমপি

মফস্বলে সাংবাদিকতা করা একটা চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনের সংসদ সদস্য এইচ এম ইব্রাহিম।

মফস্বল সাংবাদিকতা করা একটা চ্যালেঞ্জ – এইচ এম ইব্রাহিম

Comments are closed.