সল বেলোর গল্প: বাবা হওয়ার আগে

188

অনুবাদ: মোস্তফা তারিকুল আহসান

সল বেলো আমেরিকান-কানাডিয়ান বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক। জন্ম কানাডায়। ইহুদী পরিবারে জন্ম। বিশ্বসাহিত্যের এই খ্যাতিমান লেখক একাধারে নোবেল,পুলিতজার, ও ন্যাশনাল মেডেল ওব আর্টস পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো: Herzog, the adventures of of Augie, Humbold’s Gift, Henderson the Rain King, Ravelstein, Seize the day,Dangling man, More Die of Heartbreak; জন্ম :১৯১৫ মৃত্যু: ২০০৫: অনূদিত গল্পটি Mosby’s Memoirs and Other Stories ,1968 Viking Penguin,Inc. নেয়া হয়েছে।

রগিনের মনে অদ্ভুদ কিছু ধারণা তৈরি হলো। সে মাত্র একত্রিশ বছরের মোটামুটি মানানসই যুবক; মাথায় কালো ছোট ছোট চুল, ছোট চোখ তবে উঁচু চওড়া কপাল। সে একজন রসায়নবীদ। আর তাকে মনের দিক থেকে বেশ সিরিয়াস এবং নির্ভরশীল বলতে হবে। তবে একদিন যখন এক তুষারপাতের সন্ধ্যায় এই শক্তসোমত্ত যুবক ঠাণ্ডা নিবারণের জন্য বারবেরি কোর্ট পরে এলোমেলোভাবে হাঁটছিল সে যেন অন্যরকম কিছু ভাবতে শুরু করলো। সে যাচ্ছিল সাবওয়ে দিয়ে। তখন নিজেকে নতুন এক রাজ্যের অধিবাসী মনে হলো তার।
সে যাচ্ছিল তার প্রেমিকের সাথে রাতের খাবার খেতে। সে তাকে কিছুক্ষণ আগে ফোন করে বলেছে,‘তুমি বরং আসার সময় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এসো।’
তোমার কী দরকার?
একটা ডিসের জন্য সামান্য ভাজা গরুর মাংশ। আমি খালার কাছ থেকে এক পাউন্ডের কোয়ার্টার খানেক কিনেছি।
কেন কোয়ার্টার কিনলে, জন? রগিন বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
একটা ভালো স্যান্ডউইচের জন্য এইটুকু মাংশ যথেষ্ট।

তাহলে তোমাকে একটা ভালো খাবারের দোকানে অপেক্ষা করতে হবে। আমার কাছে আর টাকা নেই।
সে বলতে যাচ্ছিল গত বুধবারে তোমাকে যে ত্রিশ ডলার দিলাম তার কি হলো? তবে মনে করলো এখন এটা বলা ঠিক হবে না।
ফিলিসকে আমি কিছু টাকা দিয়েছি পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে দেবার জন্য- জন বললো।
ফিলিস হলো জনের কাজিন। তার অল্প বয়সে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। বেঢপ রকমের মোটা।ওরা দুজন একটা এপার্টমেন্টে শেয়ার করে থাকে।
রগিন বললো, ভাজা গরুর মাংশ, আর কিছু?
একটু শ্যাম্পু এনো সুইটহার্ট। আমরা সব শ্যাম্পু শেষ করে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি করো সোনা,আমি সারা দিন তোমাকে মিস করেছি।

আমিও মিস করেছি। রগিনও বললো। তবে সত্যি বলতে কি সারাদিনই সে উদ্বেগের মধ্যে ছিলো। সে তার ছোট ভাইকে কলেজে পড়ায়। মুদ্রাস্ফীতি ও ট্যাক্স বৃদ্ধি হয়েছে আর এই সময়ে মার পেনশনের টাকাটা খ্বুই সামান্য মনে হয়। জনের ঋণের টাকাও তাকে শোধ দিতে হচ্ছে। কারণ ওর চাকরি নেই। সে সুন্দরি,উচ্চশিক্ষিত এবং অভিজাত; একটা মানানসই চাকরি সে খুঁজছে। সে যেন তেন অফিসের ক্লার্ক হতে পারে না আবার পোশাকের মডেলও হতে পারে না(রগিন মনে করে এই কাজ মেয়েদের জন্য ফালতু আর তাদের কেমন যেন রগচটা করে ফেলে, সে চায় না জন এটা করুক)। সে ওয়েট্রেস বা ক্যাশিয়ারও হতে পারে না। আসলে সে কী হতে পারে? নতুন কিছু ভাবতে হবে। রগিন অভিযোগও করতে পারে না। রগিন তার সমস্ত বিল পরিশোধ করে দেয়– দাঁতের ডাক্তার, মুদির দোকান, ওস্টিওপ্যাথ, ডাক্তার, মানসিক ডাক্তার সবার বিল। ক্রিসামাসের সময় তো সে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলো। জন তাকে একটা ভেলভেটের স্মোমিং জ্যাকেট কিনে দিয়েছিলো;সেটা আবার ফ্রগ ফ্যাসেনার দিয়ে বাঁধা। আর দিয়েছে একটি সুন্দর পাইপ এবং একটি বটুয়া । সে সিলিসকে দিয়েছিলো তামার ব্রোচ, ইটালিয়ান সিল্ক ছাতা, এবং একটা সোনার সিগ্রেট কেস। অন্য বন্ধুদের জন্য সে কিনেছিলো ডাচ পাউডার,সুইডিস গ্লাসওয়ার। সে ক্ষান্ত হবার আগে রগিনের পাঁচশ ডলার শেষ করেছিলো। সে তার কষ্ট সহ্য করেছিলো এই দেখানোর জন্য যে, সে তাকে খুব ভালোবাসে। সে মনে করতো যে, তার চেয়ে জনের স্বভাব অনেক উন্নত। আর জন টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতো না। তার চরিত্র ছিলো অসাধারণ; সব সময় হাসিখুশি। তার আসলে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবার দরকার ছিলো না। সে গিয়েছিলো সিলিসের কথা মতো। সিলিস তার মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। সে তার চাচাতো বোনোর সাথে মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছিলো। আর ওর বাবা কম্বলের ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছিলো।
যখন ওষুদের দোকানের মহিলা শ্যাম্পুর বোতলটা প্যাকিং করছিলো তখন রগিনের মনে হঠাৎ একটি চমৎকার আইডিয়া এল। তার মনে হলো তোমার চারদিকে টাকা যেমন তোমাকে ঘিরে রাখে মৃত্যুও পৃথিবীকে জড়িয়ে রাখে। কত্তৃত্ব করা হলো একটি সার্বজনীন আইন। কে মুক্ত? কেউ মুক্ত নয়। কোন লোকটার ঘাড়ে বোঝা নেই? সবাই আছে চাপের মধ্যে। পাথর, জল, প্রাণি, মানুষ, শিশু– প্রত্যেকের কিছু ভার বহন করতে হয়। এই কথা প্রথমেই তার মনে স্পষ্ট হয়েছিলো। শিঘ্রই এটি গতানুগতিক হয়ে গেল,তবু এর একটি গভীর প্রভাব আছে। যেন কেউ তাকে একটি মূল্যবান উপহার দিয়েছে ( ভেলভেটের স্মোকিং জ্যাকেটের মতো নয়,ওটা তো ও পরতেই পারবে না। অথবা পাইপটা যা তাকে ধুমপান করতে উৎসাহিত করে)। এই আবেগ তৈরি হয়েছিলো মানসিক চাপ ও পরিতাপের জন্য,তবে এসব তাকে খুব কষ্ট দিয়েছে বলে মনে হয় না। বরং এর একটি বিপরীত প্রভাব ছিলো। এটা তাকে আশ্চর্য এক ভাবের জগতে নিয়ে যায়। এটা এমন অসাধারণ যে সে খুব সুখি হয়েছিলো এবং তার চিন্তার জগত প্রসারিত হয়েছিলো। চারিদিকে যা আছে সে খুব স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিল। সে খুব আনন্দের সাথে দেখছিলো কীভাবে ওষুদের দোকানদার ও মেয়েটা হাসতে হাসতে শ্যাম্পুর বোতলে চকচকে কাগজ মুড়িয়ে দিচ্ছিল। সে লক্ষ করলো কীভাবে তার মুখ থেকে দুশ্চিন্তার রেখাগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে আর তার বদলে সেখানে আনন্দরেখা যোগ হচ্ছে। সে দেখলো ওষুদের দোকানির হাত থেকে আঠা ঝলকে ঝলকে পড়ছে তবে তাতে তার বাচ্চামি বা বন্ধুত্বসুলভ আচরণে কোনোভাবে বাধা পড়ছে না। মুখরোচক রেস্তোরাঁতেও রগিন খুব পুলকিত হয়েছে এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে যে, সেখানে সে কতটা সুখি হয়েছিলো।

রোববার রাতে মুখরোচক রেস্তোরাঁটা খোলা থাকে; তখন আশে পাশে সব দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরা তখন গলাকাটা দাম নেয়। রগিন সাধারণত সতর্ক থাকে। তবে এদিন থাকতে পারি নি। অথবা ভয় পেয়েছিলো। আচার কাসুন্দি সসেজ সরিষা আর ভাজা পোড়ানো মাছের গন্ধ তাকে মাতাল করে তুলেছিলো। যে লোকগুলো চিকেন সালাদ ও হেরিং মাছের চপ কিনেছিলো তাদের দেখে রগিনের খুব মায়া হলো। বেচারারা চোখে ভালো করে দেখতে পায় না যে তারা কি কিনেছে। আসলে চিকেনের ওপর মরিচ থেতলে দিয়েছে আর ভেজা চপচপে হেরিং মাছ আর ভিনেগার দিয়ে ডোবানো বাসি রুটি ওরা কিনছে। কে এসব কিনতো? এরা অনেক দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে, একা একা থাকে, সন্ধ্যের অন্ধকারে হাঁটে আর দেখে ফ্রিজে কিসসু নেই অথবা চোখে ঠিক মতো দেখতে পায় না। এরাই এসব কেনে। তবে গরুর ভাজা মাংশটা খারাপ না। রগিন এক পাউ- অর্ডার দিলো।
যখন দোকানদার মাংশ টুকরো করছিলো তখন ক্যারিবিয়ান পিউয়ার্টো রিকান বালকের কা-কারখানা দেখে সে চিৎকার করে উঠলো। ছোড়া এক ব্যাগ চকোলেট নিয়ে টানাটানি করছিলো। ‘এই ছেলে আমি কী তোমার ওপর ডিগবাজি খেয়ে পড়বো। এই চিকো,অর্ধ মিনিট সবুর করো বাপু।’ এই দোকানদাটার দেখতে যদিও পাঞ্চো ভিলা ডাকাতদের মতো তবে সে বিনয়ী। সে তার শত্রুদের সিরাপ দিয়ে বাগে রাখার চেষ্টা করে এবং সিরাপগুলো উইঢিপির ওপর রাখে। ব্যাঙের মতো চোখ আর টান টান শক্ত বাহুর একটা লোক তার পেটের ওপর রাখা পিস্তলটার ওপর আঙুল বোলায়। লোকটা হয়তো অত খারাপ নয়। সে ছিল নিউ ইয়র্কী। রগিন মনে করে নিউ ইয়র্কীরা আসলে শহরের সব পঁচা পঁচা কাজের সাথে যুক্ত থাকে। সে অবশ্য আলবানি থেকে এসেছে। তবে তার রাজত্বে,তার মানে কাউন্টারের পেছনে কোনো উটকো ঝামেলা নেই। বরং তার দাপট আছে।
পিউয়ার্টো রিকান ছোড়াটা একটা কাউবয় টাইপের পোশাক পরেছিলোÑ বেঁচাবিক্রিতে তাকে বেশ স্মার্ট বলতে হবে। তার মাথায় সাদা দড়ি পাকানো একটা সবুজ হ্যাট,বন্দুক,বুট এবং গ্লোভস পরেছিলো হাতে তবে সে ব্যাটা একটুও ইংরেজি বলতে পারে না। রগিন খাবারের প্যাকেট নামিয়ে ছোড়ার হাতে দেয়। সে দাঁত দিয়ে পলিথিন ছিড়ে ফেলে এবং প্যাকেট থেকে শুকনো চকোলেট চিবুতে শুরু করে। রগিন তার অবস্থাটা বুঝতে পারেÑ শৈশবে তারও নেশা ছিলো একরম। তার কাছেও এই শুকনো চকোলেট তখন অমৃত মনে হতো। এখন সে একটাও খেতে পারবে না। জনের কি পছন্দ ছিলো? স্ট্রবেরি মনে হয়। না সে হয়তো বলতো, আমাকে কিছু বরফ দিয়ে স্ট্রবেরি দাও। না, রাস্পবেরি। ঘন ক্রিম এবং রোল,ক্রিম পনির এবং রাবারের মতো দেখতে শশার আচার।’
‘রাবারটা কী?’
‘ওটা আসলে ঘন সবুজ ও বেশ চোখালো। কিছু আইসক্রিমও থাকতে পারে।’
সে খুব ভালোভাবে ধন্যবাদ দেবার কথা মনে করার চেষ্টা করলো। অথবা সুন্দর উপমা। জনের জন্য আদর সোহাগের কথা ভাবলো যখন সে দরোজা খুলবে। ওর গায়ের রঙ কেমন? তার সুন্দর, ছোট্ট,সাহসী, সুঠাম, ভীতু, নরম, বেপরোয়া অথচ কমনীয় আদরের মুখের সাথে কিছুই তুলনা করা যায় না। সে কেমন কঠিন এবং সে কতটা সুন্দরী!
রগিন বদ্ধ,পাথুরে, গন্ধময় ও যান্ত্রিক সাবওয়েতে ঢুকে একজন ব্যাক্তির স্বীকারোক্তি শুনে বিভ্রান্ত হলো। লোকটা তার বন্ধুর কাছে অকপটে সব স্বীকার করছিলো। দুজনই ছিলো খুব লম্বা,শীতের পোশাকে তাদের বেশ হ্যাংলা পাতলা মনে হচ্ছিল।
একজন বললো, তাহলে তুমি আমাকে কতদিন ধরে চেন?
বার বছর।
ঠিক আছে। আমার একটা বিষয় স্বীকার করতে হবে। সে বললো। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি সব খুলে বলবো। অনেক বছর ধরে আমি মাতাল ছিলাম। তুমি জান না। আমি আসলে একজন এ্যালকোহলিক।
তবে তার বন্ধু আশ্চর্য হলো না। এবং সে সঙ্গে সঙ্গেই বললো, হ্যা আমি জানতাম।
তুমি জানতে? কীভাবে? অসম্ভব।
কেন? রগিনের মনে এটা একটা রহস্য হতে পারে।তার লম্বা,উগ্র এ্যালকোহলে ভেজা মুখ,নেশায় ধসে যাওয়া নাক,কুকুরের মতো কান,আর হুইস্কিতে সাদা হয়ে যাওয়া চোখ দেখে অবশ্য এরকম আন্দাজ করা যায়।
ঠিক আছে,যদিও আমি জানতাম।
তুমি জানতে পারো না। আমি এটা বিশ্বাস করি না। তাকে বেশ নার্ভাস লাগলো এবং তার বন্ধু তাকে একটু সান্ত¦না দেবে এমন মনে হলো না। ‘ তবে এখন আমি একদম ঠিক আছি’। সে বললো। আমি একজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম এবং পিল খাচ্ছি। এটা ডেনিসদের একটা যুগান্তকারি আবিষ্কার । এটা শ্রেফ অবিশ্বাস্য। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে তারা তোমার যে কোনো কিছু বা সব কিছু ঠিক করতে পারবে। তুমি বিজ্ঞানে ডেনিসদের হারাতে পারবে না। তারা সব কিছু করতে পারে। তারা ছেলেকে মেয়েও বানাতে পারে।
এভাবে তোমাকে তারা মদ থেকে বিরত রাখতে পেরেছে? নিশ্চয় নয়?
না। আমি সে রকম আশা করি না। এটা শুধু এ্যাসপিরিনের মতো। এটা হলো সুপার এ্যাসপিরিন। তারা বলে এটা হলো ভবিষ্যতের এ্যাসপিরিন। তুমি যদি এটা খাও তবে তোমাকে পান করা বন্ধ করতে হবে।
রগিনের উদ্দীপ্ত মন যখন এ সম্পর্কে ভাবছিলো তখন সাবওয়েতে মানুষের জোয়ার ওঠানামা করছিলো আর সড়কের নিচে গাড়িগুলো দৌঁড়াচ্ছিল আর তাদের মনে হচ্ছিল মাছের পেটের মতো স্বচ্ছ । সে কীভাবে ভাবলো যে কেউ কিচ্ছু জানতো না অথচ যা সবাই না জেনে পারে না। একজন কেমিস্ট হয়ে সে নিজেকে প্রশ্ন করে; ডেনিসদের তৈরি এই ওষুদের মধ্যে কি কি উপাদান আছে? নিজের নানা আবিষ্কার সম্পর্কে সে চিন্তা করতে শুরু করে কৃত্রিম এ্যালবুমেন, একটি সিগারেট নিজেই জ্বালাতে পারে নিজেকে,একটি সস্তা মোটর জ্বালানি। ওহ! গড। কিন্তু তার প্রয়োজন টাকার! পূর্বে যা কখনো ছিলো না। তাহলে সে কী করতে পারে? তার মা দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। গত শুক্রবার রাতে তার জন্য মাংস টুকরো করতে চায় নি। সে কষ্ট পেয়েছিলো। একটা টেবিলের ওপর তার দীর্ঘ ক্লীষ্ট বিবর্ণ চেহারা নিয়ে বসেছিলো। এবং তাকে মাংশ টুকরো করার অনুমতি দিয়েছিলো। যা সে সাধারণত কখনো করে না। সে তাকে নষ্ট করেছে এবং ভাইকে তার শত্রু করেছে। তাহলে এখন সে কী চায়? হায় খোদা! সে এর মূল্য কীভাবে দেবে? পূর্বে এমনটা কখনো হয় নি।এর একটা মূল্য তাকে দিতে হবে।
একজন যাত্রি হিসেবে বসে থেকে রগিন নিজেকে বেশ শান্ত সুখি এমনকি আলোকিত মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করলো। টাকা-পয়সা নিয়ে ভাবার অর্থ হলো পৃথিবী তোমাকে যেভাবে ভাবতে শেখায় তা করা। তারপর আবার তুমি নিজের গুরু হতে পারবে না। যখন লোকে বলে আমি টাকা অথবা ভালোবাসার জন্য কিছুই করি না; তারা আসলে বলতে চায় টাকা আর ভালোবাসা বিপরীত দুটো আবেগএবং একটি অপরের শত্রু। সে বলতে চায় কীভাবে ছোট ছোট মানুষ এই সব বিষয়ে জানে; কীভাবে তারা সারা জীবন ঘুমায়,সতর্কতার আলো আসলে কতটা ক্ষুদ্র আলো। রগিনের পরিষ্কার ও খাদানাকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; তার আত্মা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে মানুষের অজ্ঞতার গভীরতা দেখে। ওই মাতালকে তুমি উদাহরণ হিসেবে নিতে পারো যে দীর্ঘদিন ধরে জানত যে তার বন্ধু তার কুকীর্তি সম্পর্কে জানে না। রগিন দেয়ালের ওপারে তার অন্যরকম চেহারা খুঁজতে চাইলো,কিন্তু সে ততক্ষণে চলে গেছে।
যাহোক, দেখার জিনিসের তো আর অভাব নেই। একটা ছোট মেয়ে গলায় নতুন মাফলার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে;ওর মাফলারের ভেতর পুতুলের মাথা বোনা আর ও এই নিয়ে খুব খুশি আর গর্ব গর্ব ভাব তার চোখে মুখে। তার সাথে লোকটা খুব মোটাতাজা আর ভয়ানক ধরনের; বড় বেঢপ নাক। সে বাচ্চাটাকে উঁচ ুকরে সিটে নতুন করে বসায় যেন সে তাকে একটু পাল্টে দেবার চেষ্টা করছে। আরো একটা শিশুর দিকে সে নজর দিলো: ও আছে ওর মায়ের সাথে ; মা ওকে গাড়িতে বসাচ্ছে। আর অন্য বাচ্চাটার গলায় সেই একই রকম পুতুলের মুখ বোনা মাফলার। দুজনই মা-বাবাকে যথেষ্ট বিরক্ত করছে। মহিলাটিকে খুব ঝগড়াটে আর কঠিন মনে হচ্ছিল; সে তার মেয়েকে বাইরে নিয়ে গেল। রগিনের মনে হলো প্রতিটি শিশু ওদের মাফলালের প্রেমে পড়ে গেছে এমনকি তারা অন্য কিছু দেখছে না। তবে এটা তার একটা দুর্বলতা হতে পারে। সে মনে করলো সে শুধু অন্যের মনের কথা বুঝতে পারছে।
একটি বিদেশি পরিবারের প্রতি রগিনের নজর গেল। তাদেরকে তার মধ্য-আমেরিকান বলে মনে হলো। একদিকে মা,বেশ বয়স হয়েছে বোঝা যায়,মুখটা রোগাটে,শাদা চুল জরাজীর্ণ অবস্থা। অন্যদিকে একটা ছেলে; তার হাতে থালা পরিষ্কার করার শাদা সাবান। কিন্তু এদের মাঝখানে যে বামুন বসে আছে সে কী ছেলে না মেয়ে? চুল বেশ লম্বা এবং ঢেউ খেলানো, কপোল বেশ মসৃন তবে শার্ট আর টাইটা ছেলেদের। ওভারকোর্টটা মেয়েদের জুতো দেখলে ধাঁধা লাগবে। এক জোড়া অক্সফোর্ড জুতোর বাইরের দিকটা পুরুষের মতো তবে বেবি লুইস হিলটা তো মেয়েদেরই। সমতল পায়ের গোড়ালি পুরুষের। কিন্তু পায়ের পাতায় মেয়েদের মতো আকাবাঁকা দাগ। বামুনটার হাতে আঙটি পরানো। তবে বিয়ের ব্যা- নেই। কপোলে বেশ গভীর ক্ষত। চোখগুলো কুঁতকুঁতে আর কোটরের মধ্যে লুকানো। তবে রগিনের কেনো সন্দেহ হলো না যে তারা পরিস্থিতি বর্ণনা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে । আর এরা আশ্চর্য ধরনের প্রাণি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক বছর থেকে ডি লা মেয়ারের ‘মিডগেট স্মরণ’ তার মালিকানায় ছিলো। এখন এসব বন্ধ করে দিয়েছে। সে এটা পড়তে পারে। সিদ্ধান্ত নেবার সাথে সাথে তার এ বিষয়ে আগ্রহ কমে গেল অর্থাৎ বামুনটা নারি না পুরুষ সে সম্পর্কে সে আর জানতে চাইলো না। আর তার পাশে যে লোকটা বসে ছিলো তার দিকে নজর দিতে পারলো।
সাবওয়েতে বেশিরভাগ সময়ে অনেক উর্বর চিন্তার জন্ম হয়; গতি বা ভালো সঙ্গো জন্য কিংবা ধরুন সে রাস্তা, নদী বড় বড় ইমারতের নিচ দিয়ে ছুটে চলেছে সে কারণে অনেক কিছু চিন্তা করার সুযোগ থাকে। আর রগিনের মনে এরই মধ্যে অদ্ভুত সব ব্যাপার খেলা করছে। মুদির দোকানে ঝোলানো রুটি থেকে সে গোলাপের সুবাস পেল ও আচারের মশলার গন্ধ পেল;তারপর মনে হলো এক্স ও ওয়াই ক্রোমজোমের রসায়ন কীভাবে তৈরি হয়। এর মধ্যে বংশগতির যোগ কতটুকু,অথবা জরায়ুতে এরা কীভাবে মেলে। তারপর কর থেকে অব্যাহতি পাওয়া তার ভাইয়ের কথা তার মনে হলো। গতরাতে দেখা দুটো স্বপ্নের কথা তার মনে পড়লো। একটি স্বপ্নে একজন আন্ডারটেকার তার চুল কেটে ফেলার প্রস্তাব পেয়েছিল, তবে সে তা অস্বীকার করে। অন্য স্বপ্নে সে তার মাথায় করে একজন মহিলাকে বহন করছে। দুটোই খুব বাজে স্বপ্ন। খুব খারাপ। মহিলাটি কে ছিলো? জন নাকি ওর মা? আর আন্ডারটেকার কে ছিলো? তার উকিল? সে জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আর নিজের অভ্যেসের জোরে ডিমের কৃত্রিম সাদা অংশগুলোকে একত্রে রাখার চেষ্ট করে। আর মনে করে এর ফলে গোটা ডিম শিল্পে বিপ্লব হয়ে যাবে।

যাহোক, যাত্রীদের নিয়ে সে তার পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিরতি দেয় না এবং পরের সিটে বসে থাকা লোকটাকে নিয়ে রীতিমত গবেষণায় নামে। এই লোকটাকে সে জীবনেও দেখেনি তবে এখন তার সাথে তার চিনপরিচয় ছিলো বলে মনে হলো। লোকটা মধ্যবয়সী, বেশ শক্ত সোমত্ত, সাদা ত্বক আর কালো চোখ। তার হাত পরিষ্কার,সুগঠিত কবে রগিনের মোটেও পছন্দ হয় না এসব। লোকটা যে কোর্ট পরেছিলো তা নীল রঙের চেকের দামি কাপড়ের। রগিন নিজের জন্য এরকম কোর্ট একদম পছন্দ করে না। এমনকি সে নীল রঙের জুতো, বা হ্যাট পরে না। সুন্দর ফিতা দিয়ে বাঁধা চামড়া দিয়ে তৈরি ফেল্টও সে পরে না। বহু রকমের ফুলবাবু আছে এখানে, সবাই যে খুব অহংকারি তা নয়। কেউ কেউ আছে বেশ সম্মানিত মনে হয়। আর রগিনের পাশের যাত্রি বেশ সম্ভ্রান্ত। খাড়া নাকে তাকে বেশ বেশ হ্যান্ডসাম মনে হচ্ছে। যদিও সে তার উপহার ফিরিয়ে দিয়েছে তার সাধারণ চেহারার কারণে। সে তার সাধারণ কথাবার্তা ও কাজকর্মে মনে করে সে লোকজনকে সতর্ক করতে চায়, কারো ঝামেলায় ফেলতে চায় না। কারো সাথে সে আসলে কিচ্ছু করতে পারে না। সে যেরকম জুতো পরে আছে তাতে কেউ তার পায়ের দিকে তাকাবে না এবং তার দিকে কেউ মনোযোগ দেবে এমনটা আশা করাও তার উচিত না। বরং তার উচিত যে তার নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়া। সে বরং দৈনিক পত্রিকা পড়তে পারে। সে ট্রিবিউন পত্রিকাটি মুখের কাছে তুলে রাখে। লোকজন মনে করবে সে পত্রিকা পড়ছে। আসলে সে পড়ছে না। শুধু ধওে রাখে।
তার বেশ পরিষ্কার ত্বক এবং নীল চোখ। তার খাড়া এবং খাঁটি রোমান নাক এমনকি তার বসার ভঙ্গি। এসবই তার মনে হচ্ছে একজনের জন্য সে হলো জন। সে এই তুলনা দিতে চাইছিলো না তবে এটি না করেও তার উপায় নেই। জনের বাবার মতো এই লোকটাকে ওর ভালো লাগে নি। সে আসলে জনের মতো। চল্লিশের মতো বয়স। তার ছেলে। একটাই ছেলে তার ছিলো। তার ছেলে। এরকম ছেলে কী রগিনের হবে? ভবিষ্যতের বাবা! জনের সাথে উল্লেখ করার মতো তুলনা না পেয়ে সে মনে কওে তার এসব উত্তরাধিকার আসলে নেই। সম্ভবত সন্তানেরা তার মতো হবে। হ্যা চল্লিশ বছর যদি আগানো যায়। ধরো এরকম একজন গাড়ির মধ্যে তার সাথে বসে আছে হাঁটু লাগিয়ে। মহা এক উড়ন্ত ভ্রমণে বের হয়েছে লোকটা। এই লোকটা রগিনের মতো সামনের দিকে এগিয়ে।

তার জীবন নিয়ে এইসব কথা ভাবছিলো রগিন। ভাবে তার চল্লিশ বছরের জীবন তাকে কীভাবে বাধাগ্রস্ত করে; চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। সে তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে এখানেই ছিলো।রগিনের খুব ভয় লাগে। সে হাঁটতে থাকে।‘ আমার পুত্র! আমার পুত্র! সে নিজেকে বলে। এই কষ্টের অনুভবে ওর চোখে অশ্রু নেমে আসে। জীবনের মহান পবিত্র এবং ভয়জড়িত কাজের মধ্যে সে নিমজ্জিত হয় এবং ভাবে এভাবে একদিন মৃত্যু তাকে স্পর্শ করবে। আমরা আসলে দাবার ঘুটি। আমরা লক্ষ্যের জন্য কাজ করি আর মনে করি আমরা সবটা আমার করে নিয়েছি। কিন্তু আসলে তা নয়। পুরো ব্যাপারটাই অন্যায্য। শুধু কষ্ট,পরিশ্রম, সহ্যক্ষমতা আর খাটুনি তোমার জীবনকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারে; অনেকটা অন্ধকারে ভাঙা সিড়িতে হামাগুড়ি দেবার মতো; কঠিন পথ থেকে বাঁচার জন্য, মাজা শক্ত করে দাঁড়াবার জন্য, অর্থের জোগান দেবার জন্য: শুধু এই দুনিয়ায় চতুর্থ গ্রেডের বাবা হওয়ার জন্য এসব তোমাকে করতে হবে। বাবা মানে অতি সাধারণ দেখতে, সাদামাটা, গাঢ় গোলাপি, অনিচ্ছুক, যা পাবেন তাতেই খুশি অথবা খাঁটি একখানা বৃুর্জোয়া মুখচ্ছবি। বোকা ছেলের বাবা হওয়া তো রীতিমতো অভিশাপ। এমন ছেলে তোমার হলো যে কখনো বাবাকে বুঝবে না। তাদের সত্যিকার অর্থে কিছু নেই,কিন্তু আবার কারোর সাথে মিল নেই; সে এবং তার পরিচ্ছন্ন, গোলগাল নীল চোখের তারা। সে খুব খুশি। তবে যা করেছে, পেয়েছে এবং সে আসলে যা তা ঠিক মতো বলতে পারবে না কাউকে। ওর ঠোটের দিকে তাকান; ঠোটের ওপর যেন ছোট্ট একটা কাঁটা লেপ্টে আছে। এই সময়টা সে কারো সাথে ভাগাভাগি করতে পারে না। এখন থেকে চল্লিশের ওপর উঠে গেছে তাই? পৃথিবীর যেমন ঢের বয়স হয়ে কেমন ন্যূব্জ হয়ে গেছে তার অবস্থাও কী সেরকম? পরবর্তী প্রজন্মের অমানবিক কা-কারখানা তাকে বিমর্ষ করে তোলে। বাবা ও সন্তানের মধ্যে কোনো গভীর বন্ধন নেই। কী ভয়ঙ্কর! কী অমানবিক! এই চিন্তা তাকে কোন গ্রহে নিয়ে যাবে? মানুষের ব্যক্তিগত লক্ষ্য বলে কিছু নেই? সব মায়া? জীবনীশক্তি দিয়ে আমরা জীবনের পরিপূর্ণতা দেবার চেষ্টা করছি সব সময় নিজস্ব মানবিকতাকে পদদলিত করে । শুধু নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ডাউনোসোর বা ভল্লুকের মতো আমাদের ভালোবাসাকে নির্দয়ভাবে বলি দিচ্ছি; নিজেদের সামাজিক নানা ধারায় বইয়ে দিচ্ছি,গাধার মতো খাটছি,টাকার জন্য জান প্রাণ দিচ্ছি; চাপের মুখে মাথা নত করছি,জাগতিক সব নিয়মে বন্দী হয়ে পড়ছি। সবই তো কুসংস্কার।
আমি কোন বাতিঘরে যাচ্ছি? রগিন ভাবলো। একজন বাবা হওয়ার জন্য আরেক বাবার কাছে ফিরে যাওয়া? একজন সাদাচুলো, মোটাসোটা বদরাগি কুৎসিত নীল চোখের বৃদ্ধ বাবার মতো কাউকে ভাবতে রগিনের মেজাজ বিগড়ে যেতে থাকে। তার দাদাকে দেখতে একরমই লাগত। জনকে এখন তার অসহ্য মনে হচ্ছে। সেও তাকে কোনো সাহায্য করতে পারে না। তার জন্য এটা অনিবার্য। রগিনের জন্যও কী অনিবার্য? ঠিক আছে, রগিন,তুমি বোকা। তবে শুধু যন্ত্র হয়ে থেক না। এখান থেকে বেরিয়ে পড়ো।
কিন্তু আসলে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল। কারণ সে ইতিমধ্যে তার পুত্রের পাশে বসার অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি নিয়ে ফেলেছে। তার এবং জনের পুত্র। সে পুত্রের দিকে তাকায়; তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। তবে এই কল্পিত ছেলে খুব ঠা-া হয়ে চুপচাপ বসে থাকে যদিও সে রগিনের কা-কারখানা পর্যবেক্ষণ করে। তারা একই স্টেশনে অর্থাৎ সেরিডান স্কোয়ারে নামে। সে যখন স্টেশনের প্লাটফর্মের দিকে হাঁটতে শুরু করে তখন লোকটা রগিনের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করে। তখনো তার পরনে নীল চেকের নোংরা কোর্ট আর মুখটা বিশ্রি কদর্য আর গোলাপি।
গোটা ব্যাপারটা রগিনকে খুব বাজেভাবে মর্মাহত করলো। যখন সে জনের দরোজার কাছে পৌঁছল এবং নক করার আগেই সে শুনল ফিলিসের ছোট্ট কুকুর হেনরি ঘেউ ঘেউ করছে। ওর মুখটা শুকিয়ে গেল। সে নিজেকে বললো, আমি আমাকে ব্যবহৃত হতে দেব না। আমার বেঁচে থাকার অধিকার আছে। জনের অনেক পথ খোলা। সে কঠিন সব পথ থেকে সরে যেতে পারে যা অনেক সময় রগিন তার ওপর চাপাতে চেয়েছিলো। জন মনে করতো তার ওপর যেন কোনো ঝামেলা না আসে। রগিন এই বিলাসী চাকচিক্য জীবনযাপন করতে পারে না। কারণ তাকে টাকা আয় করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। সে চায় তার কাজে কোনো ঝামেলা না হোক। ঠিক আছে, এই অবস্থায় পরিস্থিতি তাকে সাহায্য করবে না। তবে এখন সে টাকার কথা মনে রাখবে না যদি সে বুঝতে পারে জন সাবওয়ের ছেলের মতো কোনো ছেলের মা হতে যাচ্ছে না অথবা সত্যি সতি্যা কোনো মেয়ের মা হতেও যাচ্ছে না। আর সে কোনো অবৈধ সন্তানের বাবা হতে যাচ্ছে না। আসলে রগিন তার বাবা মায়ের মতো নয় এবং তার ভাইয়ের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।
জন দরোজার কাছে এল। সে ফিলিসের দামি হাউজকোর্ট পরেছিলো। তাকে এই পোশাকে দারুন দেখাচ্ছিল। প্রথমে তার উজ্জ্বল হাসিখুশি মুখ দেখে সে চমকে গেল। কিসের সাথে তুলনা দেবে বুঝতে পারছিলো না। তার পোশাক আলো ঝলমল করছিলো তবে এটা দেখে তার শরীর রাগে কাঁপতে লাগল।
সে রগিনকে চুমু খেতে খেতে বললো, ওহ! মাই বেবি,তুমি তো তুষারে ঢেকে গেছো; তুমি কেনো হ্যাট পরো নি? মাথাটাতো শেষ হয়ে গেছে সে তৃতীয় পক্ষকে আদরের সুরে বলল যেন।
ঠিক আছে আগে আমাকে জিনিসপত্রগুলো রাখতে দাও। কোর্টটা খুলি। অভিযোগের সুরে বললো রগিন এবং তার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হলো। কেন সে তার জন্য অপেক্ষা করে নি? ‘এই ঘরটা তো খুব গরম। আমার মুখ পুড়ে যাচ্ছে। তবে ঘরটা এইরকম গরম করে রেখেছ কেন? আর এই কুত্তার বাচ্চা ঘেউ ঘেউ করছে অনবরত। যদি তুমি এটাকে ঠাণ্ডা রাখতে তাহলে সে গোটা পরিবশটা নষ্ট করতো না। তাকে কি বাইরে নিয়ে হাঁটাবার কেউ নেই?’
না এখানে সত্যি খুব গরম না। তুমি তো কেবল ঠা-া থেকে এলে তাই। তুমি কি মনে করো না এই কোর্টটা ফিলিসের চেয়ে আমাকে বেশি মানিয়েছে? বিশেষ করে নিতম্বের কাছে। সে ও তাই মনে করে। ও এটা আমার কাছে বিক্রি করতে পারে।
আমি সে রকম মনে করি না। রগিন বিস্মিত হলো।
সে একটা তোয়ালে এনে রগিনের মাথা থেকে গলিত বরফ মুছে দিতে থাকে। এলোমেলো তোয়ালের ঘষাঘষি সহ্য করতে করতে পারে না। হেনরি সে বেশ উত্তেজিত হতে থাকলে জন তাকে বেডরুমে আটকে রাখে। সেখানে সে দরোজার সামনে বিরতিহীন লাফাতে থাকে আর পা দিয়ে কাঠের দরোজায় তালে তালে ধাক্কা ধাক্কা দিয়ে একটা তালের বাদ্য বাজাতে থাকে।
জন বলে, তুমি কি শ্যাম্পু এনেছিলো?
এই যে শ্যাম্পু।
তাহলে ডিনারের আগেই আমি তোমার চুলে শ্যাম্পু করব, এসো।
আমি এখন মাথা পরিষ্কার করতে চাই না।
ওহ! আসো তো। সে হাসতে হাসতে বললো।
তার এই অতিরিক্তি আগ্রহ বা খানিকটা অপরাধপ্রবণতায় রগিন খানিকটা আশ্চর্য হল। সে জানে এটা এখন সে কীভাবে করবে। আর সুন্দর সাজানো গেছানো কার্পেটে সজ্জিত পর্দা লাগানো আলোকোজ্জ্বল রুমটা যেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। এজন্যেই নিজেকে অপরাধী মনে হলো আর সে বেশ রেগে গেল। মনের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেল। তবে এরকম তার কেন হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা সে দিতে চাইল না। সত্যি তার মনে হল যদি সে কারণটা বলতে চায় তাহলে পরিস্থিতি তার নাগালের বাইরে চলে যাবে।
তারা দুজন মিলে তার কোর্ট ও শার্ট খুলে ফেলল এবং জন সিংকে পানি ভর্তি করলো। রগিনের মনের মধ্যে উথাল পাথাল ভাব; তার দুই বুক সম্পূর্ণ নগ্ন; ওর মনে হলো বুকটা যেন অনেক ভেতরে। সে নিজেক বললো, তাকে খুব সুন্দর করে শিঘ্রই আমাকে কিছু বলতে হবে। এই সবের মধ্যে আমাকে তা ভুলে গেলে চলবে না। সে তাকে বলতে থাকে, তুমি কী মনে করো আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া সারা দুনিয়ার বোঝা আমি একা বইতে পারি? তুমি কী মনে করো এতসব আমাকেই করতেই হবে? আমাকেই এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে? তুমি কী ভাবো যে আমি একটা প্রাকৃতিক বড় ভাগাড়? আমি কী কয়লার খনি? নাকি তেলের খনি? নাকি মৎস্য খামার বা অন্য কিছু? মনে রেখ, আমি একজন মানুষ। আমার ওপর এত বোঝা চাপানো উচিত নয়। আমার একটা আত্মা আছে তা তোমার চাইতে বড় বা শক্তিশালি না। বাইরের ছাল চামড়া মাংস খুলে ফেল,কিংবা আমার ভেতরে শব্দ উৎপাদন ক্ষমতা। তখন আর কী থাকে? সবার মতো একটা আত্মা। সেখানে কেন সমতা থাকবে না। আমি কখনোই অন্যের চেয়ে শক্তিশালি হতে পারি না। এখানে বসো। জন বললো। কিচেন থেকে সে একটা বসার টুল নিয়ে এল। ‘তোমার সব চুল জট পাকিয়ে গেছে।
সে ঠা-া এনামেলের পাত্রের সাথে বুক লাগিয়ে বসলো; চিবুকটা বেসিনের ধারের সাখে লাগানো: গ্লাস আর টাইলসে সবুজ গরম উজ্জ্বল জলের ধারা চক চক করছে আর শ্যাম্পুর মিষ্টি ঠাণ্ডা ঝোল ওর মাথার ওপর পড়ছে। জন পরিষ্কার করতে থাকে।
তোমার শরীরের গঠন খুবই চমৎকার: গোটা শরীর গোলাপি। জন বলে।
ঠিক আছে। তবে শাদা হওয়া উচিত। আমার ভেতরে নিশ্চয় কোনো সমস্যা আছে। রগিন বলে।
না তোমার মধ্যে সত্যিকার অর্থে কোনো সমস্যা নেই। জন বলে। আর পেছন দিক দিয়ে ওকে চেপে জড়িয়ে ধরে। আর তার সারা শরীরে মৃদুভাবে জল দিতে থাকে যতক্ষণ না মনে হয় জলটা বের হয়ে আসছে তার শরীরের ভেতর থেকে। এটা আসলে তার শরীরের উষ্ণ তরল ভালোবাসার প্রসবণ যা সিং থেকে ছাপিয়ে পড়ছিলো। ছাপিয়ে পড়ছিলো সবুজ ঘন ফেণার মধ্য দিয়ে। আর তার মনের মধ্যে জমে থাকা বিক্ষুব্ধ কথামালা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। পুত্র বিষয়ে তার যে দুশ্চিন্তা তা কোথায় যেন উবে গেল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবং জলে পরিপূর্ণ সিংকের ভেতর থেকে জনকে বললো, ‘জন,তোমার কাছে সব সবময় এরকম নতুন নতুন আইডিয়া থাকে। তুমি জানো? তোমার একটা বিশেষ মানসিক ক্ষমতা আছে,এটা আমার এটা বিশেষ উপহার।’

আরও পড়ুন

Comments are closed.