রাইড শেয়ারিং নীতিমালা ও এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট
বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরে ডিজিটালাইজেশন বা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। গতানুগতিক পরিবহন ব্যবস্থা, অব্যবস্থাপনা ও তীব্র সিন্ডিকেট নৈরাজ্যের কারণে যখন রাজধানীর মানুষ অতিষ্ঠ ঠিক তখনই রাইড শেয়ারিং সেবার আবির্ভাব হয় ব্যস্ততম নগরী তথা যানজটের এ ঢাকায়। সরকার পরিবহন সেক্টরের অব্যবস্থাপনা ও তীব্র সিন্ডিকেট নৈরাজ্য ঠেকাতে বারংবার পদক্ষেপ নিলেও আশানুরূপ কোনো ফল হয়নি।
প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রস্তাবিত রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেও তার মৃত্যুর পর এ উদ্যোগ আশার আলো না দেখায় শহরে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হয়নি। আসার কথা হচ্ছে বর্তমান রাইড শেয়ারিং সেবা আবির্ভূত হওয়ার পর রাজধানীর মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছে।
নিরাপত্তা এবং কল্যাণের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষ করে রাইড শেয়ারিং সেবা খাতে শৃঙ্খলা আনয়নে ‘রাইড শেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা-২০১৭’ প্রণয়ন করে সরকার। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খসড়া তৈরি শুরু করে বিআরটিএ। বিআরটিএ-এর এনফোর্সমেন্ট বিভাগের পরিচালককে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে ওই বছরের ২১ জুন সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠায়। সরকার ১৫ জানুয়ারি ২০১৮ সালে এ নীতিমালা অনুমোদন করে যা একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। জনস্বার্থে জারিকৃত এ নীতিমালা ২০১৮ সালের ৮ মার্চ থেকে কার্যকর রয়েছে। এ নীতিমালায় ৮টি অনুচ্ছেদ ও ১২টি শর্ত রয়েছে। নীতিমালা প্রণয়নের পর এর আলোকে ১৬টি প্রতিষ্ঠান এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য বিআরটিএ বরাবর আবেদন করে এবং উবার, পাঠাও, সহজ ও পিকমিসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। নীতিমালা অনুমোদন পাওয়ায় আশার আলো দেখলেও কয়েকটি অনুচ্ছেদ বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ক, ঙ তে সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন মনে করছে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো পাশাপাশি অনুচ্ছেদ খ-১, অনুচ্ছেদ-খ-(৮-খ), অনুচ্ছেদ চ-১ বিষয়ে বর্ণিত শর্তাবলী পূরণ করার সঙ্গে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সমন্বয়ের বিষয় জড়িত থাকায় কিছুটা সময়ের প্রয়োজন মনে করছে প্রতিষ্ঠান গুলো।
বিশেষ করে অনুচ্ছেদ-ক, ধারা (৯) অনুযায়ী-
‘এ নীতিমালার অধীন একজন মোটরযান মালিক মাত্র ১টি (এক) মোটরযান রাইড শেয়ারিং সার্ভিস এর আওতায় পরিচালনার অনুমতি পাবেন।’
শর্তটি বিকাশমান এই খাতের উপর শুধু নেতিবাচক প্রভাবই ফেলবে না সম্ভাবনাময় এ ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে বলে দৃঢ় ভাবে আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে। অর্থনীতিতে অবদান রাখা এ খাত নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতেও বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। রাইডার বা চালক কিংবা একটি মোটরযানকে একাধিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের প্লাটফর্মে যুক্ত না হওয়ার নির্দেশ রাইড শেয়ারিং এর প্রতিযোগিতামূলক বাজারকে হুমকির সম্মুখীন করবে। যা মোটরযান মালিক/চালককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধাগ্রস্ত করবে এবং এর ফলশ্রুতিতে তাদের কাঙ্খিত আয়-উপার্জন কমে যাবে। এ বিধান একচেটিয়া বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে, যা এ সেবা প্রদানকারী বহু ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানসমূহের বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অথচ, একাধিক রাইড শেয়ারিং কোম্পানির আওতায় নিবন্ধন ও সেবা প্রদানের সুযোগ চালকদের আর্থিকভাবে কাঙ্খিত উপার্জনে সহায়তা করবে।
অনুচ্ছেদ-খ, ধারা (১) অনুযায়ী-
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশনে এমন একটি এসওএস সুবিধা রাখতে হবে, যার বোতাম স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গে মোটরযান চালকের তথ্যাদি ও যাত্রীর জিপিএস লোকেশন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৯৯৯ নম্বরে চলে যাবে;
এ শর্তটির বাস্তবায়ন আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট রাইড শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা (৯৯৯) অ্যাপ্লিকেশনের ইন্টিগ্রেশনের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে মেট্রোপলিটন পুলিশ কন্ট্রোল রুমের উপর নির্ভরশীল বিধায় এ বিষয়ে কত সময় লাগবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বাংলাদেশ পুলিশের মধ্যে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অগ্রগতিমূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-খ, ধারা (৮-খ) অনুযায়ী-
নির্বাচন কমিশনের তথ্য ভাণ্ডারের সঙ্গে ইন্টিগ্রেশন এ শর্তটির বাস্তবায়ন আরেকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল অর্থাৎ জাতীয় পরিচয় পত্রের ভেরিফিকেশন ইন্টিগ্রেশনের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভাবে নির্বাচন কমিশনের উপর নির্ভরশীল বিধায় এ ব্যাপারে কত সময় লাগবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে এ বিষয়ে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান সমূহ নির্বাচন কমিশন বরাবর আবেদন করেছে যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অনুচ্ছেদ-ঙ, অনুযায়ী-
রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের আওতায় চলাচলকৃত ব্যক্তিগত মোটর কারের ভাড়া ‘ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিস গাইডলাইন, ২০১০ অনুযায়ী’ নির্ধারিত ভাড়া অপেক্ষা বেশি হতে পারবে না তবে কোনো কারণে ভাড়া সংক্রান্ত যাত্রী অসন্তোষ সৃষ্টি হলে সে ক্ষেত্রে সরকার ভাড়া নির্ধারণ/পুনঃনির্ধারণ করতে পারবে।
এক্ষেত্রে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে সময় উপযোগী মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করার অনুমতি দেওয়া উচিত। বিশেষ করে ট্যাক্সিক্যাব নানা ধরনের আমদানির সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে যা ব্যক্তি খাতের কোন মোটরযান ভোগ করে না। যেহেতু রাইড শেয়ারিং ব্যবসার ধারণা পদ্ধতি ট্যাক্সিক্যাব সার্ভিসের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা ও প্রযুক্তি নির্ভর তাই এ খাতের জন্য একটি স্বতন্ত্র ভাড়া কাঠামো থাকা প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে।
অনুচ্ছেদ-চ, ধারা (১) অনুযায়ী-
বিআরটিএর ওয়েবসাইটে এ গাইডলাইনের আওতায় অনলাইনে কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য ওয়েবপোর্টাল স্থাপন ও এতদসংক্রান্ত তথ্য বিআরটিএ এর ডাটাবেজে সংরক্ষণসহ যাবতীয় কারিগরি সহায়তা রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নিজ খরচে প্রদান করবে; বিষয়টি বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ বিআরটিএ-কে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে।
কাঙ্ক্ষিত এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট পাওয়ার বিষয়ে বর্ণিত শর্তাবলী পূরণ করার সঙ্গে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সমন্বয়ের বিষয় জড়িত থাকায় কিছু কিছু অংশ রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে ইচ্ছা করলেই পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় সম্ভাবনাময় এ ইন্ড্রাস্ট্রিকে আরো গতিশীল করার জন্য এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট ইস্যু করা প্রয়োজন। গত ২৭ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোলডার বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশের প্রতিনিধি, হাইওয়ে পুলিশের প্রতিনিধি, পরিবহন মালিক সমিতির প্রতিনিধি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিক সমিতির প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট প্রদানের বিষয়ে সচিব মহোদয় বিআরটিএ-কে নির্দেশ প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশে যখন পরিবহন সেক্টরে ডিজিটাইলাইজেশনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে ঠিক তখনি কোনো এক অদৃশ্য কারণে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ম মেনে এ নীতিমালার আলোকে সেবা পরিচালনা করলেও তারা প্রত্যাশিত লাইসেন্স হাতে পায়নি। যে দেশে গণপরিবহন সাধারণ মানুষের কাছে এক বিভীষিকার নাম। যে দেশে সিন্ডিকেট নৈরাজ্যের কারণে প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বাস্তবায়ন হয় না। যে দেশে সড়ক পরিবহন আইনকে অমান্য করে ফিটনেসবিহীন গাড়ির দৌরাত্বে মানুষ জিম্মি তখন নীতিমালা বা নিয়মের বাইবেল আমাদের সামনে আসেনা। যখন অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবাগুলো এ শহরে মানুষের কাছে সাশ্রয়ী এবং জনপ্রিয় হতে শুরু করলো ও স্বস্তির কারণ হলো ঠিক তখনি নীতিমালা-নিয়মের দোহাই দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সার্টিফিকেটের বিষিয়টি বিলম্ব করা হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ ইন্ড্রাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে, দেশের পরিবহন সেক্টরকে ডিজিটালাইজ ও অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সরকারকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
Comments are closed.