রবীন্দ্রনাথকে কি উত্তর-আধুনিক বলা যাবে: পর্ব-০২
সময় গড়ানোর সাথে সাথে এই ভাবনার ওপরও কালি জমতে থাকে। যে পথ ছিল গন্তব্যের একমাত্র আলোকবর্তিকা; সেই পথ হয়ে উঠলো বহু রঙে রঞ্জিত আলোর মিছিল। কোনটাই মিথ্যা নয়; নতুন করে বিনির্মিত ভাবনায় কোন কিছুকেই পরিত্যাগ করার উপায় থাকলো না। ভাবনার এই উদারতায় এক পর্যায়ে সন্ধান মিলল বহুপথের, খুলে গেল দক্ষিণ দুয়ার। যে ঘরের জানালা ছিল রুদ্ধ, কড়া শাসনে যে ছেলেটি ঘরের বাইরে যেতে পারতো না, তার সামনে আজ দশ দুয়ার খোলা। সামনে বহু বিচিত্র রংধনুর মতন ভাবনার নানাগামী পরিচয়। এখানে স্থির বলে কিছু থাকলো না, থাকলো চেতনার অবিরাম প্রবাহ। আপেক্ষিকতার উদার স্পর্শে সেই প্রবাহ ঘাটে ঘাটে খেয়ার তরীর মতন একেক জনের কাছে একেক রকম হয়ে ধরা দিলো। আদতে জগতের কোন পরিবর্তন হয়নি; আগে যা ছিল এখনো তাই। পরিবর্তন হয়েছে বোধের; পাল্টেছে দৃষ্টি। আগে যেটাকে হাঁস মনে করা হচ্ছিল, সেই একই চিত্রপটে সেটা এখন খরগোশ। এই বোধের বিভাজনের ওপর একেকটা লেভেল এঁটে দেওয়া হলো। কোনটা প্রাচীন, কোনটা মধ্য বা কোনটা আধুনিক কিংবা উত্তর-আধুনিক। মোটকথা চিন্তার যে ক্রমপরিবর্তনশীলতা তার পরতে পরতে জগতোপলব্ধির বাতাবরণ নিয়ে কাল বিভাজন করেছে মানুষ। এই বিভাজনের একটা অধ্যায় হচ্ছে উত্তর-আধুনিক অথবা আধুনিক উত্তর পর্ব, ইংরেজিতে যার একটা গালভরা নাম তৈরি হয়েছে পোস্ট-মডার্নিজম। প্রশ্ন হচ্ছে, রবিঠাকুর কি এই নব বোধের অনুগামী হয়ে উঠেছিলেন? সেটা জানতে আমাদের অপেক্ষা করা উচিত ওই পর্যন্ত, আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতার বিভাজন রেখাটা কী? সেটার পরিষ্কার অবস্থান।
আলোচনার সাত সকালেই বলে দিই, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্টোলজিক্যালি মোনিস্ট কিন্তু এপিস্টিমলজিক্যালি রিলেটিভিস্ট। এই এপিস্টিমলজিক্যাল রিলেটিভিজমের প্রেক্ষাপটে তাঁকে উত্তর-আধুনিক না বলে উপায় নেই। অবশ্য উত্তর-আধুনিক চিন্তার পটভূমি তৈরি হওয়ার আগেই তাঁর জীবনাবসান হয়। আলোচনার পর্যায়গুলোয় আমরা দেখবো, তিনি যাকে আধুনিকতা বলছেন তার অনেক অংশই উত্তর-আধুনিকতার সমার্থক। তবে অবশ্য মনে রাখতে হবে, তিনি সত্যকে যে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন; সেই সত্য কিন্তু তাঁর তত্ত্বগত বা অধিবিদ্যক বিবেচনা, যার মূল কেন্দ্র উপনিষদ। সে হিসেবে মনে হবে, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রযুগের ব্যাপ্তিকাল আধুনিক যুগের প্রতিনিধিত্ব করে। সেই দৃষ্টি থেকে, তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর আধুনিক। কারণ তিনি বার বার উচ্চারণ করেছেন, ঘটনা বহু কিন্তু সত্য এক। সেই সত্য কী? সেই সত্যে আনাদির আদি, পরম ও একমাত্র সত্তার অধিষ্ঠান। তার বিলয় নেই, নেই কোন বিকার। সাহিত্যের বিচিত্র ভান্ডারে সেই সত্য ফুটে ওঠে আপন মহিমায়। প্রাচীনকাল থেকে কবি-সাহিত্যিক সেই সত্য খুঁজে ফিরেছেন নিজের ডেরায়। আর এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে সত্যের বহুগামিতা। ভাবনার চলমান সিঁড়িতে একের পর এক রূপ বদলের পালায় এসেছে আধুনিকতা এবং আধুনিকোত্তর সৃষ্টির বিচিত্র উপাচার। ‘আধুনিক কাব্য’য় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও তেমনি বরাবর সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মডার্ন। বাংলায় বলা যাক আধুনিক। এই আধুনিকটা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’ (সাহিত্যের পথে, ১০১)। তাহলে দাঁড়ালো এই, প্রাচীনযুগ যেটাকে বলছি; সেটাও এক সময় আধুনিক ছিল। আবার এখন যে উত্তর-আধুনিক যুগ পার করছি বলে পণ্ডিতরা দাবি তুলছেন; সেটাও প্রকারন্তে আধুনিক যুগেরই নামান্তর। তবে আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক যুগ বলতে আমরা যে কেতাবি বিভাজন করেছি, তার নিশ্চয়ই একটা বিভেদক সীমানা আছে। দেখি সেটা।
যে মর্জির কথা রবীন্দ্রনাথ বললেন, সেটা হচ্ছে চিন্তার গুণগত উপাদান। এই গুণের মধ্যে খুঁজতে হবে সংস্কৃতি, রাজনীতি, নীতিবোধ, বিজ্ঞান, সাহিত্যে, শিল্প কিংবা চিত্রকলা। সতেরো থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি ইউরোপে ধর্ম বিশ্বাস, সাহিত্য, দর্শন, নীতিবোধ, স্থাপত্য, বাস্তুতন্ত্র, সামাজিক বন্ধন, এমনকি বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত অগ্রায়ন নিয়ে যে পরিবর্তন দেখা দিলো সেটা আগের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আলাদা হয়ে গেল মানুষের জীবনাচার। মানুষের মাঝখানে ভিড়ে গেল যন্ত্র। ইঞ্জিন উদ্ভবের সাথে সাথে কারখানার কাজ হাতছাড়া হলো মানুষের। যে কাজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মানুষ হাতে করতো, সেই কাজ নিমিষেই করে ফেলল ইঞ্জিন। বিদ্যুৎ, রেলগাড়ি, স্টিমার, টেলিফোন, উন্নত রাস্তা, লেখার উপকরণ, ছাপাখানা, ভালো কাগজ, ইত্যাদি সবকিছু গণজীবনে পরিবর্তন এনে দিলো। এই পরিবর্তনের প্রভাব গিয়ে পড়লো জ্ঞানের শাখাগুলোয়। তারমধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্য হয়ে দেখা দিলো সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ও শিল্পকলা। যুগ বিভাজন নিয়ে বিশেষ কোন সীমানা নির্ধারণ খুব বেশি স্বস্তিদায়ক ব্যাপার না। তারপরেও বলা যায়, অতি প্রাচীন কাল থেকে পৌনে পাঁচশ সাল পর্যন্ত সময়কে প্রাচীন, তারপর সেখান থেকে থেকে সাড়ে চৌদ্দশ সাল পর্যন্ত মধ্যযুগ ও তার পরবর্তী সময়কে আধুনিক যুগ বললে খুব বেশি বেমানান হবে না। অনেকে মনে করেন, ষোড়শ শতক থেকে আধুনিক যুগের সূত্রপাত ঘটে। কৃষিনির্ভর সমাজ থেকে শিল্প-সমাজে উত্তরণের ফলে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের পরিবর্তন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। ফলশ্রুতিতে তার প্রতিফলন ঘটেছে শিল্পাঙ্গনে, সাহিত্য ও দর্শনে। বিজ্ঞানে তো অবশ্যই।
আধুনিক যুগ মানুষকে সরিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে। অগণিত সৃষ্টির মাঝে মানুষও যে কেবল তাদের মতোই একটা সৃষ্টি, এই বোধ কিন্তু আধুনিক যুগে প্রবল হয়ে ওঠে। বিশ্ব সৃষ্টির কোন কিছুই অহেতুক না, তারাও যে মূল্যবান সেই চেতনা দ্রুত জায়গা করে নিলো এখানে। কার্ল মার্কস, ডার উইন এ দু’জন প্রবলভাবে মানুষের হাজার বছরের বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানলেন। উল্টে দিলেন ভাবনার চাকা। এ দুজনের সাথে এগিয়ে আসলেন পদার্থবিজ্ঞানী, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, মনোবিশ্লেষক, নৃবিজ্ঞানী কিংবা ভাষাবিজ্ঞানী। বিশ শতকের মধ্যলগ্ন পর্যন্ত চিন্তাবিজ্ঞানীরা একটা প্যাটার্নের সৃষ্টি করে তুললেন। প্যাটার্নের সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ‘নতুন করে ভাবা’ বা ‘ভাবনার নতুন দিগন্তের উন্মোচন করা’ ছিল প্রথম কাজ। এজরা পাউন্ডের ভাষায়, ‘মেক ইট নিউ’। পুরোনো বদ্ধ ও অচঞ্চল ধারণা ক্রমে বিদায় নিয়ে দ্রুত সেখানে জায়গা করে নিলো গতিময়, হাল ফ্যাশনের উড়ু উড়ু অষ্টাদশী কিশোরীর মতন চপল বোধ। এর একদিকে থাকলো যুক্তিবাদ অন্যদিকে ঐতিহ্যকে বর্জন করে নিরীক্ষাধর্মী বাস্তবতা। বহুকালের পুরোনো বাড়ি ছিল বড় বড় হাতির পায়ের মতো থাম, ওপরে রেলের পাটি দিয়ে তৈরি ছাদ, আর চামচিকার বাসা বানানো বহু যুগ আগের কড়ে বর্গা। সেগুলো ভেঙে গুড়িয়ে বানান হলো পাতলা গোছের চকচকে ফ্ল্যাট। ঐতিহ্যের এই বিপুল পরাজয়ের মধ্যে গড়ে উঠলো নতুনের গোড়াপত্তন। এটাই আধুনিকতা। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘বাল্যকালে যে ইংরেজি কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় হল তখনকার দিনে সেটাকে আধুনিক বলে গণ্য করা চলত। কাব্য তখন একটা নতুন বাঁক নিয়েছিলো, কবি বার্নস থেকে তার শুরু। এই ঝোঁকে একসঙ্গে অনেকগুলি বড়ো বড়ো কবি দেখা দিয়েছিল। যথা, ওয়ার্ডওয়াথ, কোলরিজ, শেলি, কিটস।’ (আধুনিক কাব্য, সাহিত্যের পথে, ১০১)। অষ্টাদশ শতকের স্কটিশ কবি বার্নস অর্থোডক্স নৈতিকতা ও গতানুগতিক সাহিত্য বোধের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ সৃষ্টি করেছিলেন। বার্নস তাঁর কবিতার মধ্যে ব্যবহার করেছেন প্রেম, লৈঙ্গিক বৈষম্য, যৌনাচার, দারিদ্র্য, গোঁড়াবাদ, প্রজাতন্ত্রবাদ ইত্যাদি। অবশ্য অস্বীকারের উপায় নেই, চরম হতাশাও তাকে আচ্ছাদন করেছিল জীবনে। বার্নসকে স্কটল্যান্ডের জাতীয় কবি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
সাহিত্যে আচার বলে একটা কথা আছে। দীর্ঘকাল ধরে বয়ে আসা স্রোতের মতন ভাবনাগুলো মানুষ দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বাঁচে। সেখান থেকে ‘কণা টুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে ‘হায় হায়’।’ এটাই আধুনিক পূর্ব ও আধুনিক ভাবনার পার্থক্য। তবে আধুনিক ভাবনায় ছিল একটা সামষ্টিক ছাদ। এই ছাদের নিচে যারা অবস্থান নিয়েছে, তাদের ভুলতে হয়েছে ব্যক্তিত্ব, ভুলতে হয়েছে স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্য। ‘কুমুদকহ্লার সেবিত সরোবর’ হলো ‘সাধু-কারখানায় তৈরি সরকারি ধুলির বিশেষ ছিদ্র দিয়ে দেখা সরোবর’। কিন্তু সাহিত্যে এমন কিছু ঘটে বা এমন কিছু সৃষ্টি হয় যা রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সাহিত্যে কোনো সাহসিক সেই ঠুলি খুলে ফেলে বুলি সরিয়ে পুরো চোখ দিয়ে যখন সরোবর দেখে তখন ঠুলির সঙ্গে সঙ্গে সে এমন একটা পথ খুলে দেয় যাতে করে সরোবর নানা দৃষ্টিতে নানা খেয়ালে নানাবিধ হয়ে ওঠে।’ (আধুনিক সাহিত্য, ১০২)। রবীন্দ্রনাথ নিজের কথা বলছেন, ‘আমরা যখন ইংরেজি পড়া শুরু করলুম তখন সেই আচার-ভাঙা ব্যক্তিগত মর্জিকেই স্বীকার করে নিয়েছিল।’ (প্রাগুক্ত, ১২০)। এখন এর মূলে প্রবেশ করা যাক।
চলবে…
Comments are closed.