আমেরিকায় বাঙালি বসতির চার শতক

147

সৈয়দ জিয়াউর রহমান: পশ্চিম গোলার্ধে বিশেষ করে, আমেরিকায় বাঙালি বসতি কবে শুরু হয়, এ তথ্য সংগ্রহের জন্য ওয়াশিংটন ডিসির লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের সাহায্য নিয়েছিলাম। নথিপত্র থেকে জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতারও আগে বাঙালিরা মহাসিন্ধুর এপারে বসতি শুরু করে। ১৭৭৩ সালে ফরাসিদের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের যুদ্ধ শেষে বাঙালিদের পদার্পণ ঘটতে থাকে আমেরিকার মাটিতে। ওই যুদ্ধে ব্রিটেনের কাছে ফরাসিদের পরাজয় ঘটে কানাডায়, আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশে এবং বঙ্গদেশে। সে সময় ‘স্যার এডওয়ার্ড রায়ানস মিশন’ নামে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের একটি অভিযান পরিচালিত হয় বাংলা ভূখণ্ড থেকে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চল থেকে ক্রীতদাস এনে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের মাটিতে চা উৎপাদনের কাজে লাগানোর লক্ষ্যে। কিন্তু দেখা যায় পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গ, মিশিগানের ডেট্রয়েট ও অন্যান্য এলাকার জমি চা-চাষের উপযোগী নয়। বাঙালি ক্রীতদাসদের কাজে লাগানো হয় তুলা চাষে। ১৭৮০-এর দশকে ইংরেজ কর্মকর্তারা প্রচুর অর্থকড়ির বিনিময়ে দরিদ্র বাঙালি তরুণীদের সংগ্রহ করে আমেরিকায় নিয়ে আসেন উপপত্নী ও পরিচারিকা হিসেবে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিয়ের নাম করে। সেসব বাঙালি তরুণী আর কখনোই দেশে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাননি। তাঁদের বংশধররা এখনো বাঙালি পরিচয় বহন করে।

এ সি সাদারল্যান্ড নামে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কর্মকর্তার আত্মচরিত থেকে জানা যায়, উনিশ শতকের শুরুতে তিনি সিলেটে যান তাঁর ম্যাজিস্ট্রেট ভাইয়ের বাড়িতে এবং সেখান থেকে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের তরুণীকে সঙ্গে নিয়ে আসেন পেনসিলভানিয়ায়। পরে তাঁর স্ত্রী হিসেবে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত এই তরুণীর বাকি জীবন কাটে আমেরিকার মাটিতে।

উনিশ শতকের শুরু থেকেই ব্রিটিশ জাহাজে কর্মরত নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের জাহাজি শ্রমিকেরা সুদীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় পরিশ্রান্ত হয়ে বাল্টিমোর, বোস্টন, নিউইয়র্ক—এসব বন্দরে নেমে পড়তেন। জাহাজ থেকে কর্মীদের এই নেমে পড়াকে বলা হয় ‘শিপ-জাম্পিং’। বাঙালি জাহাজি-শ্রমিকেরা ‘শিপ-জাম্পিং’-এর পর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে গা-ঢাকা দেয় এবং পরে এ দেশের কৃষ্ণাঙ্গ অথবা পুর্টোরিকান পরিবারে বিয়ে করে সারা জীবনের জন্য থেকে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকায় কৃষি ও শিল্পে অদক্ষ শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং সে সময় জাহাজ থেকে নেমে পড়া বাঙালি শ্রমিকেরা স্থায়ী জীবিকার সন্ধান পায়।

এমআইটির এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত গবেষক-অধ্যাপক বিবেক বাল্ড বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের একটি বাঙালি অভিবাসী পরিবারের সন্ধান পান এবং এ বিষয়ে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধানের পর বেঙ্গলি হারলেম অ্যান্ড দ্য লস্ট হিস্ট্রিজ অব সাউথ-এশিয়ান আমেরিকান নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তার এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, হাবিবুল্লাহ নামে নোয়াখালীর একজন জাহাজ-শ্রমিক ম্যাসাচুসেটসের বোস্টন বন্দরে জাহাজ থেকে নেমে পড়েন এবং নিউইয়র্কের কৃষ্ণাঙ্গ-অধ্যুষিত শহরতলি এলাকা হারলেমে আশ্রয় নেন। পরে সেখানে এক পুর্টোরিকান পরিবারে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। তিনি ১৯৪০-এর দশকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটন এলাকায় ‘বেঙ্গল গার্ডেন’ নামে একটি রেস্তোরাঁ চালু করেন। হাবিবুল্লাহর বংশধররা এখন নামের শেষে পদবি হিসেবে ‘উল্লাহ’ ব্যবহার করেন। অধ্যাপক বিবেক বাল্ডে গ্রন্থে ওই সময় মিশিগান রাজ্যের ডেট্রয়েট এলাকায়ও পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বেশ কয়েকজন বাঙালি মুসলমানের বসতি প্রতিষ্ঠার কথা জানা যায়।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তানি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে আসার বেশ কিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে সেই সুযোগের প্রায় পুরোটাই লাভ করে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। তার ফলে আমেরিকায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অভিবাসন ঘটে পশ্চিম পাকিস্তানিদের। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতা বিষয়ে ছয় মাসের একটি উচ্চশিক্ষা কর্মসূচিতে আটজন পাকিস্তানিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দেশের দুই অংশ থেকে চারজন করে সাংবাদিক বাছাইয়ের পরামর্শ দেয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাছাই করা হয় সাতজনকে—আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে সুযোগ পান মাত্র একজন সাংবাদিক। তিনি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এর চিফ রিপোর্টার ও স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার সম্পাদক শহীদুল হক। এভাবে আমেরিকায় দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকতে হয় বাঙালি অভিবাসীদের।

১৯৭৬ সালে আমি ভয়েস অব আমেরিকায় যোগ দেওয়ার জন্য ওয়াশিংটনে আসি, তখন এই এলাকায় বাংলাদেশি ছিলেন শ দেড়েকের মতো। সে সময় ওয়াশিংটনের বাঙালি সম্প্রদায় ছিল প্রধানত কয়েকজন শিক্ষক-ছাত্র, চিকিৎসক, প্রকৌশলী-স্থপতি আর ভয়েস অব আমেরিকা, বাংলাদেশ দূতাবাস এবং বিশ্বব্যাংক, আইএফএফে কর্মকর্তাদের নিয়ে। আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যে কবার আমাকে নিউইয়র্কে যেতে হয়েছে, ভিও-এর কাজে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের খবরাখবর পরিবেশনের জন্য, সে সময় আমার ওপর একটি বাড়তি দায়িত্ব ছিল নিউইয়র্ক শহরে নানা পেশায় নিয়োজিত বাংলাদেশিদের সাক্ষাৎকার নেওয়া। কিন্তু নিউইয়র্কে তখন বাংলাদেশি অভিবাসীদের সন্ধান পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য। একবার এ কাজে আমাকে সাহায্য করেছিলেন মনোজ ভৌমিক নামে নিউইয়র্কবাসী পশ্চিমবঙ্গের এক বাঙালি তরুণ। তিনি ছিলেন ব্রডওয়ে সংশ্লিষ্ট একটি নাট্যগোষ্ঠীর অভিনেতা এবং সুলেখক। তিনি একদিন আমার হোটেলে এসে জানালেন, একজন বাংলাদেশির সন্ধান পেয়েছেন। তিনি থাকেন নিউইয়র্ক শহরের কুইন্স এলাকায়। তাঁর নাম জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, তাঁর স্ত্রী পূরবী বসু ক্যানসার-গবেষক। লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তকে নামে চিনতাম, পরিচয় ছিল না। মনোজ ভৌমিকের প্রচেষ্টায় বিশিষ্ট লেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের বাড়িতে আমার রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ আসে, সেখানে তাঁর ও তাঁর স্ত্রী পূরবী বসুর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়। মনোজ ভৌমিক আরও সন্ধান দিয়েছিলেন নিউইয়র্কে ‘কারী ইন-এ হারী’ নামে একটি বাংলাদেশি রেস্তোরাঁর মালিক নুরুল ইসলামের। এই ছিল তখন নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি।

৩৬ বছর পরে এখন নিউইয়র্ক শহরে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। ওয়াশিংটনের মেট্রোপলিটন এলাকায় ২৫ হাজারের বেশি। অনেক বাংলাদেশি আছেন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। সেখানে বাঙালি-অধ্যুষিত একটি এলাকার সরকারিভাবে নামকরণ করা হয়েছে বাংলা-টাউন। দক্ষিণ আরিজোনা রাজ্যের মরুভূমি শহর ফিনিক্সেও এখন কয়েক হাজার বাংলাদেশির বসতি। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য মিলে এখন বাংলাদেশিদের সংখ্যা সাড়ে আট লাখ থেকে নয় লাখের মতো।

সৈয়দ জিয়াউর রহমান: ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সম্পাদক।

আরও পড়ুন

Comments are closed.