অহিংসার প্রতীক নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট ও জাদুঘর

277

সাইফুল্যাহ কামরুল : অহিংস নীতির অন্যতম প্রবর্তক মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগ গ্রামের গান্ধী আশ্রম স্ট্রাস্ট। গান্ধীর জীবনদর্শন প্রচারে ট্রাস্ট যেমন কাজ করছে, তেমনি ট্রাস্ট প্রাঙ্গণে গান্ধী স্মৃতি জাদুঘরটি দাঁড়িয়ে আছে অহিংসার প্রতীক হিসেবে।

বৈষম্যের শিকার নিরীহ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে ‘অহিংসার’ মাধ্যমে সহিংসতা মোকাবিলায় পৃথিবীব্যাপী স্মরণীয় হয়ে আছেন মহাত্মা গান্ধী। তার বাবার দেওয়া নাম মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনিই তার কর্মের মাধ্যমে হয়ে ওঠেন মহাত্মা গান্ধী। প্রতিবছর ২ অক্টোবর মহান নেতার জন্মবার্ষিকীতে পালন করা হয় জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস (নন ভায়োলেন্স ডে)।

সারা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হয় নানা আনুষ্ঠানিকতায়। আর গান্ধীর ‘অহিংসা’ দিয়ে সহিংসতা মোকাবিলার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দেশব্যাপী শান্তি প্রচারাভিযান নামের কর্মসূচি পালন করে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট।

গান্ধীর হাত ধরে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট

ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভয়াবহ রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় কলকাতার পর ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে একই রকম দাঙ্গা সংঘটিত হয় তখনকার পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতে। ১০-২৩ অক্টোবর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে এ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেই দুঃসময়ে মহাত্মা গান্ধী শান্তি মিশন নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে নোয়াখালীতে আসেন। ১৯৪৬ সালের ৭ নভেম্বর রেলযোগে তিনি জেলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনী রেলস্টেশনে নামেন। এরপর বর্তমান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামে জনসভার মধ্য দিয়ে গান্ধী তার গ্রাম পরিক্রমা শুরু করেন। ৭৭ বছর বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি প্রতিটি গ্রাম হেঁটে হেঁটে মানুষকে শোনান শান্তির অভয় বাণী। তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় তিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কার্যক্রম, হিন্দু-মুসলিম সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেবামূলক কর্মকা- শুরু করেন। গ্রাম পরিক্রমার একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি সোনাইমুড়ীর জয়াগ গ্রামে পৌঁছেন। সেখানে ৩০ জানুয়ারি একটি বুনিয়াদি বিদ্যালয় উদ্বোধন করেন তিনি। বিদ্যালয়টি বর্তমানে গান্ধী মেমোরিয়াল নামে পরিচিত।

জয়াগ গ্রামের অপুত্রক নবকৃষ্ণ সরকারের দৌহিত্র তৎকালীন জমিদার এবং নোয়াখালীর প্রথম ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ জয়াগে গান্ধীর আগমন ও তার বাড়িতে অবস্থানের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে নিজ জমিদারির সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাবা অম্বিকাচরণ ঘোষ ও মাতা কালীগঙ্গা চৌধুরানীর নামানুসারে ‘অম্বিকাকালীগঙ্গা দাতব্য স্ট্রাস্ট’ গঠনের মাধ্যমে গান্ধীজিকে দান করেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার উন্নয়ন সাধন ছিল এই ট্রাস্টের লক্ষ্য। আর এভাবেই শান্তি মিশনে কর্মরত গান্ধীর কর্মীদের একটি স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা হয়, যার প্রচলিত নাম ছিল গান্ধী ক্যাম্প।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার অম্বিকাকালীগঙ্গা চেরিট্যাবল ট্রাস্ট ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে এর নামকরণ করেন গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট। এ অধ্যাদেশ অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট গঠিত হয় এবং বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্যকে এর সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এই ট্রাস্টের মাধ্যমেই মহাত্মা গান্ধীর জীবনদর্শন প্রচার ও বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে এ ট্রাস্টের সভাপতি ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।

১৯৪৬ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৪৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গান্ধী নোয়াখালী অবস্থান করেন। এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলায় প্রবেশ করেন। পূর্ব বাংলায় শান্তি পরিক্রমাকালে বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবর পেয়ে গান্ধীজি সেই দাঙ্গা নিরসনের উদ্দেশ্যে সেখানে যাওয়ার জন্য বিচলিত হয়ে পড়েন। ২ মার্চ তিনি মৃদুলা সারাভাই, মানু গান্ধী ও চারু চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে বিহারের উদ্দেশে কলকাতা রওনা হন।

কলকাতার হাওড়া স্টেশনে চারু চৌধুরী বিদায় চাইলে গান্ধীজি তাকে নোয়াখালীতে ফিরে গিয়ে শান্তি মিশনে কাজ করতে বলেন। আরও বলেন, ‘আমি তো আবার আসব।’ গুরুর নির্দেশে চারু চৌধুরী নোয়াখালীতে ফিরে আসেন। গান্ধীর নির্দেশমতে চারু চৌধুরীর সঙ্গে নোয়াখালীতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন দেবেন্দ্র নারায়ণ সরকার, মদনমোহন চট্টোপাধ্যায়, সাধনেন্দ্র নাথ মিত্র, বিশ্বরঞ্জ সেন, রঞ্জন কুমার দত্ত, অজিত কুমার দে, জীবন কুমার দে ও সত্য নারায়ণ। তাদের কেউই আজ আর জীবিত নেই।

গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর

‘অহিংস’ সমাজ প্রতিষ্ঠায় গান্ধীর কর্মময় জীবনকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন দুর্লভ ছবি, বই ও জিনিসপত্র নিয়ে ২০০০ সালের ২ অক্টোবর গান্ধী আশ্রমের মূল ভবনে প্রতিষ্ঠা করা হয় গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিচারপ্রতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ এটি উদ্বোধন করেন। প্রতিদিন (সোম থেকে শনিবার) সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন অসম্প্রদায়িক ও অহিংস সমাজ গঠনে মহাত্মা গান্ধীর ভূমিকার নানা দিক দেখতে।

জাদুঘরে রতি গান্ধীর কর্মময় জীবনের কিছু কথা, কিছু ছবি, কিছু স্মৃতি যে কারো চিন্তার জগতকে নাড়া দেবে। কোনো ব্যক্তির স্মৃতি কিংবা ব্যক্তিজীবনের কর্মকা- নিয়ে এমন জাদঘুর সত্যিই বিরল।

জাদুঘরে প্রবেশ করতেই মহাত্মা গান্ধীর বিশাল আব মূর্তি সবার নজর কাড়ে। গান্ধীজির শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৩০টি ছবি শোভা পাচ্ছে এ জাদুঘরে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বদেশি আন্দোলনের সময় বিলাতি পোশাক বর্জনের ডাক দিয়ে যে চরকায় গান্ধী সুতা কাটতেন, জাদুঘরে সংরতি সেই চরকা এখনো মানুষের চিন্তাকে নাড়া দেয়। ১৯২৪ সালে অল ইন্ডিয়া ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে তোলা মহাত্মা গান্ধীর ছবিটি এখনো মানুষকে শোষণ মুক্তির সংগ্রামের ডাক দেয়।

গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট সূত্রে জানা যায়, বাবা কাবা গান্ধী এবং মা পুতলী বাঈর সন্তান মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী)। তিনি ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন ভারতের গুজরাট রাজ্যের পৌরবন্দরে। ১৮৯১ সালের ১০ জুন লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন তিনি। দণি আফ্রিকার বর্ণবাদী সহিংসতা দেখতে ১৮৯৩ সালের এপ্রিলে সেখানে যান তিনি। দণি আফ্রিকা যাওয়ার পথে কালো হওয়ার অপরাধে প্রথম শ্রেণির টিকিট থাকা সত্ত্বেও ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় গান্ধীজিকে। এ ছাড়া শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা অশ্বেতাঙ্গদের নানাভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন দারুণভাবে নাড়া দেয় তাকে। মানুষের অধিকার রার আন্দোলন নতুন মাত্রা যোগ হয় মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা আন্দোলনে। গান্ধী সহিংসতা মোকাবিলার পরীা শুরু করেন ১৯০৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দণি আফ্রিকার জোহানেসবার্গে সত্যগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে। পরে যা গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল এই ‘অহিংসা’।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লির এক প্রার্থনাসভায় যোগ দিতে যাওয়ার পথে নাথুরাম গডসের হিংসার বুলেটে গান্ধীর দেহাবসান ঘটে।

গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের পরিচালক রাহা নবকুমার জানান, শান্তিপূর্ণ, অহিংস ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়তে সাতটি সামাজিক পাপ পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন গান্ধীজি। এগুলো হচ্ছেÑ নীতিহীন রাজনীতি, চরিত্রহীন শিা, মানবতাহীন বিজ্ঞান, নৈতিকতাহীন বাণিজ্য, শ্রমহীন সম্পদ, বিবেকবর্জিত আনন্দ ও ত্যাগহীন শিা। এ সাতটি সামাজিক পাপই গান্ধীজির দৃষ্টিতে সহিংসতা সৃষ্টির জন্য দায়ী। তাই সাতটি সামাজিক পাপ মোচনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতেই গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি আরও জানান, ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই গান্ধীজির জীবনদর্শন অনুযায়ী মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি, সংঘাত এড়ানো এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে। তন্মধ্যে চরকা শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে খাদি বস্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো, দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, কৃষি ও শিার বিকাশে কর্মসূচি গ্রহণ অন্যতম।

এ ছাড়া সত্যগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাবাষিকী, গান্ধীজির জন্মবার্ষিকী ও প্রয়াণ দিবস ঘিরেও নানা কর্মসূচি পালন করা হয় ট্রাস্টের প থেকে।

আরও পড়ুন

Comments are closed.